অফিসের সবাই যখন ‘বস’

Bossesইশরাত জাহান উর্মি: ভোররাতে একবার ঘুম ভাঙবেই। প্রতিরাতেই। ছোটবেলায় আজানের সময় ঘুম ভাঙলে কিসব সূরা-টুরা পড়তাম। বিশ্বাস করতাম, আজান যখন শোনা যায়, তখন এই সূরা পড়ে যা চাইবো তাই পাবো। অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, যা চাইতাম, তা পেতামও! সূরা পড়েই? বলি তবে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় একদিন একটা মঞ্চ নাটক দেখতে গিয়ে নাটকে বাউলের চরিত্রের গলায় একটা গান শুনে আমার এই সূরা পড়ে কাঙ্খিত সব পাওয়ার ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম। গানটা হলো,

যে যা মনে আশা করে

দয়াল গুরু পূর্ণ করে

যদি ভক্তিভরে চায়…

অর্থাৎ যা চাও তা চাইতে হবে ভক্তি ভরে। নি:শ্বাস বন্ধ করে আবার বাতাস ফিরে পাওয়ার মতো করে। সেই নিষ্পাপ, বিশ্বাসী মনটা তো আর নেই, তাই এখন সূরা পড়েও কাজ হয় না, হবে না জানি।

কি বলতে এত আমড়াগাছি করছি, তাই বলছি। প্রতি ভোররাতেই ঘুম ভাঙে। আব-জাব কত কি মনে পড়ে আবার ঘুম ভাঙার আগে পর্যন্ত! আর গত কয়েকদিন ধরে ঘুম ভাঙতেই অদ্ভুত এক ট্রমা। কতদিন হবে, প্রায় ২০দিন। অফিস তো সেই কবে থেকেই আমার কবিতা পড়া, সিনেমা দেখে আপ্লুত হওয়া, কাশ্মির বা আমেরিকা, বান্দরবান বা থাইল্যান্ড দেখে মুগ্ধ হওয়ার মনটা কেড়ে নিয়েছে।

আমার বর পর্যন্ত বলে, কাজ উপভোগ কর না, তা কর কেন? আমি কিছু বলি না। এই এতদিন পর এসে চাকরি করার প্রয়োজনীয়তা বা নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে কচকচ করতে ইচ্ছে করে না। তবে এবার যে একটা ঘটনায় এতদিন ট্রমাটাইজ থাকবো সত্যি ভাবিনি।

ঘটনা তেমন কিছুই না, অফিসে এক আওয়াজবাজ জুনিয়র কলিগ প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করল। এককথা-দুই কথায় তর্কে সে যে ভাষা প্রয়োগ করল, আমি খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে ছিলাম। দুইদিনের ছেলে। কর্তা ব্যাক্তিদের লাই পেয়ে এমন মাথায় উঠেছে যে আর সবকিছু বাদই দিলাম, বয়সে বড়দের সাথে মিনিমাম শ্রদ্ধাটুকু যে রেখে কথা বলতে হয়, তা-ও ভুলে গেছে। সারাক্ষণ গলাবাজি, কোটারি করা এইসব বাচ্চাদের আমি সত্যিই ক্ষমা করে দিই। তেল মালিশ করা আর সিন্ডিকেট করেই বড় সাংবাদিক হওয়া যায়-ওরা এসব দেখেই প্রফেশনে বেড়ে উঠেছে। ওদের কোন দোষ আমি সত্যিই দেখি না। আর ভাবি, এখন যদি কোন জুনিয়র তার সিনিয়রদের সম্মান করে তো এটা সেই বড়র ভাগ্য, করবে না-এটাই রিয়েলিটি এবং এটাই স্বাভাবিক।

আমি সেসব নিয়ে ভাবছি না। ট্রমাটা হলো জাস্ট ওর ব্যবহার করা একটা বাক্যে। তর্কের এক পর্যায়ে সে যা বলল তার মূল হলো, টেলিভিশন সাংবাদিকতা অনেক কষ্টের, এত কম সময় অফিসে দিলে হবে না, ওর বা ওদের মতো অনেকক্ষণ অফিসে থাকতে হবে। পারলে ডে অফ এর দিনেও টিশার্ট পড়ে অফিসে এসে আড্ডা মেরে দেখাতে হবে যে, অফিস কতটা পেয়ারের।

ওর কোন দোষ দেখি না আবারও বলছি। জেন্ডার ইনসেনসেটিভ কোন আচরণ না করার দাবি করা এই অফিসের ভেতরে ভেতরে ‘‍আপনাদের মেয়েদের নিয়ে আর পারি না, খালি বাচ্চা আর সংসারের দোহাই দেন’—বলা লোকের কি অভাব আছে?

Urmi ATN
ইশরাত জাহান উর্মি

সারাক্ষণ অভিযোগের ডালি নিয়ে হাঁটা যায় না। তাই এদের কথা শুনেও না শোনার ভান করি, আবার হয়তো দরজায় গিয়ে হাত পাতি, সকালে না বিকেলে, বিকেলে না সকালে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েন বস। সকালে বাচ্চার টীকার ডেট কোনদিন, বিকেলে ননদের বাড়িতে দাওয়াত কোনদিন, না গেলে ধুন্ধুমার হবে, ননদের চেয়েও বেশি গাল ফোলাবেন ননদের ভাইটি…

এভাবেই ব্যালেন্স করি, বলা হয় না, বাচ্চা ছেলে, কাজ তোমার চেয়ে কম বুঝি না, কম করি না, কিন্তু আওয়াজ দেয়া শিখিনি। আর শিখিনি অসততা। তাই অনেক ঝামেলা সত্বেও অফিসের বসেরা যাতে ঝামেলায় না পড়েন তাই নিজের কাজটুকু করে, আট ঘন্টা পার করে বাড়ি ফিরতে চাইলেই তোমার মতো সুবিধাপ্রাপ্ত অকালপক্কদের ধমক খেতে হয়। তার চেয়ে যদি অফিসে না এসে মিথ্যে বলে দিতাম তোমাদেরই কারো কারো মতো যে জ্বর বা ডাইরিয়া—তাহলে নিদেনপক্ষে ফাঁকিবাজ গালি শুনতে হতো না। কৌশলী হওয়াটা একটা গুণ এখন। সেই গুণ আমার আয়ত্ত্বে নেই।

এইসব ঘটনা, ট্রমা সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা আমার করছে তা হলো, আমার জেদ, সাহস আর উদ্যমকে গলা টিপে একটু একটু করে মেরে ফেলছে, আমি যেন বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, আমি আসলেই কাজে ফাঁকি দিই, অফিসকে সময় দিই না। আমার আসলেই যোগ্যতা নেই। আমি কিছু পারি না। এইসব কুচো চিংড়িরা আমাকে হারিয়ে দিচ্ছে! আমি দিগভ্রান্ত হচ্ছি। আমাকে কি কেউ বলবে,

জিইয়ে রেখো জিদ

থেমো না সুহৃদ…।

লেখক: সাংবাদিক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.