রোজ নামচা-১৯

সুপ্রীতি ধর:

রেহনুমা বলছিল, বাসায় জামা বদলালে বা ব্যাগ থেকে কিছু নেয়ার জন্য ব্যাগে হাত দিলেই সর্বনাশ। সাড়ে সাত মাস বয়সী দস্যু ছেলেটা ঝাঁপ দিয়ে কোলে চলে আসে। তার ভয়, মা বুঝি এই চলে গেল। টানা ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে অফিস ফেরাটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই তাকে না বলে, লুকিয়ে বের হতে হয় বাসা থেকে। অফিসে এসেও শান্তি নেই, বার বার ফোন করে, ছেলেটা কি করছে, খাচ্ছে কিনা, কাঁদছে কিনা! সাংবাদিকতার চাকরি, এখানে মনোযোগ ছাড়া কাজ করা সম্ভব না। কিন্তু সেই মনোযোগটাই আজকাল হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে।

অফিস ফিরে দুদিন যেতে না যেতেই আবার ছুটির দরখাস্ত দেয়। এর আগেও তার দুমাস বিনাবেতনে ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল। এবারও তাই। তবে এবার একটা সমাধানে আসা গেছে, কিছুদিন পর্যন্ত সে ফ্রিল্যান্স কাজ করবে। তাতে করে সময়টা নিজের মতোন করে গুছিয়ে নিতে পারবে। তাও মন মানে না তার।

ছবিটি সংগৃহীত

সহকর্মী শুভানুধ্যায়ী, বা বরং বলা যায়, যারা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে অতীতে, তারা রেহনুমাকে পরামর্শ দেয়, এভাবে ছুটি না নিতে। এতে করে অফিসে তার দুর্নাম হয়ে যাবে। এমনিতেই মেয়েদের চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে নানারকম টালবাহানা দেখানো হয়। এখন বল যদি পুরুষতান্ত্রিকতার হাতে তুলে দেয়া হয় নিজে থেকেই, তখন আর শেষরক্ষা হবে না। তাছাড়া জীবন তো পুরোটাই সামনে, ছুটিগুলোও থাকা দরকার। কখন, কী প্রয়োজন পড়ে!

রেহনুমা সব শোনে, এমনকি বুঝেও। তারপরও গাড়িতে বাসায় ফিরতে ফিরতে জিজ্ঞাসা করে, আমি কি তাহলে অন্য চাকরি দেখবো?

সহকর্মী বলে উঠে, না না, তা কেন করবি? এখানে যে সুযোগটা তুই পেয়েছিস, অন্য জায়গায় তাও পাবি না। তাছাড়া মিডিয়া হাউসগুলো এখন আর তেমন নেই। কেউ কাকে ছাড় দেয় না। বরং উল্টো, সবাই তখন তোর পিছনে লেগে চাকরিটা খাবে। দরকার নেই।

সহকর্মীটিও জানে, রেহনুমার ভিতরে কী ক্ষরণ হচ্ছে! সন্তান জন্মদান একদিকে যেমন নারীকে পূর্ণতা দেয়, তেমনি জীবনটাকে নি:শেষও করে দেয়, অহেতুক শত্রু তৈরি করে চারপাশে, যদি সে কর্মজীবী হয়।

বিদেশের অনেক দেশে সন্তান জন্মের পর তিন বছর পর্যন্ত মা মাতৃত্বকালীন ছুটি পায়। তিনটা বছর সে তার সন্তানটিকে বুকে আগলে, ভালবেসে বড় করার প্রয়াস পায়। তাছাড়া শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে জীবনের প্রথম এই তিনটি বছর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ই গড়ে উঠে একটি শিশুর মূল ভিত্। তাই এই সময়টায় মায়ের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙ্গে গিয়ে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, আর সংসারের দৈনন্দিন খরচও নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় মেয়েটিকেও চাকরি করতেই হয় বাধ্যতামূলকভাবেই। তাছাড়া করবে নাইবা কেন! এখন আর সেই যুগ নেই, যখন মেয়েদের পড়ানো হতো ভাল বিয়ের জন্য। এখন মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই কেবল সংসারের ছক কাটে।

কিন্তু তাকে করে তাদের এই কূল-সেই কূল সব কূল রক্ষা করতে করতেই কেটে যায় এক জীবন। পিছনে যখন ফেরেন, তখন সেখানে সাফল্য যতটা না থাকে, ব্যর্থতার অভিযোগ থাকে আরও বেশি।

নীপার যখন বাচ্চা পেটে আসে, তখন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চলছে। চারদিকে নির্বাচনি হাওয়া। আট মাসের পেট নিয়েই নীপা চলে যায় নির্বাচনের সংবাদ পাঠাতে, পাছে তার এই অবস্থাকে পুঁজি করে কথা শোনাতে না পারে কেউ। দিব্যি সে দায়িত্ব পালন করে আসে। বাচ্চা জন্মের পর সময়মতোই সে কাজে যোগ দেয়। অনেকদিন দেখেছি, নীপার স্বামী দিনের একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর ফিডার হাতে করে অফিসে আসতে। নীপা বুকের দুধ সাক করে তা ভরে দেয়। স্বামীটি আবার ছোটে বাচ্চাকে খাওয়াতে দৌড়ে যায় বাসায়। এভাবেই সে পাড়ি দিয়েছে কঠিন সময়গুলো।

তবে মনিকার গল্পটা অন্যরকম। সেখানে স্বামী বা পরিবারের কেউ ছিল না, ছিল শুধু গৃহকর্মী। সিঙ্গেল মা হওয়ার সুবাদে ওই গৃহকর্মীই ছিল তার সাক্ষাত লক্ষ্মী। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য সাত মাসের বাচ্চাকে রেখে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল মনিকা। আর ঘরে ফেরা হয়নি তেমন করে। এরই মাঝে ১৪দিনের ট্রেনিং পড়েছিল মানিকগঞ্জের কৈট্টায়। ট্রেনিং ক্লাসে বসে মনিকার জামা বেয়ে পায়জামাও ভিজে যেত দুধে। কাপড় চাপা দিয়েও কুল রক্ষা হতো না। প্রায় প্রতিদিনই সে ট্রেনিং এর নিয়ম ভেঙ্গে ঢাকায় চলে আসতো ফিরতি গাড়িতে উঠে। রাতভর বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে আবার কাক-ডাকা ভোরে অফিসের গাড়িতে করে ছুটতো মানিকগঞ্জ। তিনদিনের মাথায় সবাই টের পেয়ে যায় একথা। ট্রেনিং শেষে একটা চিঠি তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল সেই সুবাদে।

চিঠিটা তার চাকরি হারানোর না হলেও কম অপমানজনক ছিল না। ডিপার্টমেন্ট চেঞ্জ। চোখ-মুখ বুঁজে সেটি তখন মেনে নিলেও মনিকা সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, এখানে আর নয়। ঠিকই সে একদিন বেরিয়ে এসেছিল সেই অফিস ছেড়ে।

তবে ওটা ছেড়ে যে অফিসে সে এসেছিল, সেখানেও খুব সুখকর ছিল না দিনগুলি। সেকথা অন্য একদিন হবে। নতুন ডায়রিতে।

মনিকার মায়ের বেলা ছিল আরও কঠিন। সেই সময় রাস্তাঘাট আজকের মতোন পিচঢালা ছিল না। লক্কর-ঝক্কর, মুড়ির টিনের মতোন বাসে করে সেই মাকে প্রতিদিন অফিসে যেতে-আসতে হতো। ভোর চারটায় স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরতেন, আর সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরতেন। ফিরেই কাপড়টা বদলে নাকে-মুখে কিছু দিয়ে রাতের রান্নায় লেগে যেতেন। সেইসময় লাকড়ির চুলায় রান্না হতো। সবার খাওয়া হতে হতে রাত ১১টা-১২টা। হারিকেনের আলোয় পড়তে গিয়ে সন্তানরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, আওয়াজ না পেয়ে রান্নাঘর থেকে মায়ের চিৎকার, কীরে, পড়া শোনা যায় না কেন? ছোট মেয়েটিকে দুমাসের রেখে চাকরিতে ফিরেছিলেন সেই মা। দুধ না খাওয়াতে পেরে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতেন তিনি। ৬২ বছর বয়সে সেই না খাওয়ানো দুধ আবার ফিরে এসেছিল, ফোঁড়ার মতোন ফুলে উঠেছিল মায়ের স্তন। সে যে কী দু:সহ যন্ত্রণা। এসবই জীবনের খেরো খাতার একেকটা গল্প।

ব্যতিক্রমও যে নেই, তা কিন্তু না। চেনাজানা একজন আপার বাচ্চা হচ্ছিল না অনেকদিন। বার বার নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। পরে অনেক চিকিৎসায় তিনি যখন নতুন করে গর্ভধারণ করেন, তখন পুরো নয় মাস তিনি বিশ্রামে ছিলেন। বাচ্চা হওয়ার পর আরও ছয় মাস। চাকরি কিন্তু তার বহালই ছিল। ফেরত এসে আবার সদর্পে চাকরি করে যাচ্ছেন এখন পর্যন্ত।

সেই ভাগ্য সবার হয় না। বেশিরভাগ মাকেই অনেক ছার দিয়ে, অনেক কষ্ট সয়ে, মনের ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করে যেতে হয়। পুরুষ সহকর্মীদের একেকটা হাসির কথাও তখন বিদ্রুপাত্মক মনে হয়।

তারপরও এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। এভাবেই সংসারে-সমাজে সব জায়গায়। জীবন খাতা শূন্য না পূর্ণ, তা দেখার সময়ই বা কই?

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.