রাফিয়া জাকারিয়া: ইট ছুঁড়ে ফারজানা পারভিনকে হত্যার আগেও শাহিদা পারভিনকে ঘটা করে, রীতিমতোন দণ্ডাদেশ দিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে, যখন দেশটিতে গণতন্ত্র নতুন এসেছে, এবং একজন নারী যখন ক্ষমতা আরোহন করতে যাচেচ্ছন, ঠিক সেই মূহূর্তে দেশেরই অপর এক নারীকে এমন নির্মমভাবে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল।
শাহিদা পারভিন এবং মোহাম্মদ সারোয়ারের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল এ কারণেই যে, শাহিদার আগের স্বামী অভিযোগ করেছিলেন, তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দেননি। শাহিদা যদিও বার বারই বলেছিলেন যে, মৌখিকভাবে তিনবার তালাক শব্দটা উচ্চারণ করেছে তার আগের স্বামী এবং এরপর তাকে তার বাবার বাড়িতেও পাঠিয়ে দিয়েছিল, তারপরও আদালত বিশ্বাস করেনি তার কথা। এরপর শাহিদা লিখিত ডিভোর্স ডিক্রি নিয়ে এলেও আদালত বিশ্বাস করেনি। অথচ আদালতই বলেছিল, রেজিস্টার্ড ডকুমেন্ট লাগবে ডিভোর্সের। শাহিদা তাই এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালত বিশ্বাস না করায় শাহিদার দ্বিতীয় বিয়ে ‘অবৈধ’ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, শরীয়া আইনে গুরুতর ‘গুনাহ’ বলে প্রমাণ হয়। এর পরিণামে মৃত্যুই একমাত্র শাস্তি জোটে শাহিদা এবং সার ভাগ্যে। তাও যেন-তেন প্রকারে মৃত্যু নয়, পাথর ছুঁড়ে তিলে তিলে হত্যা। ফারজানার মতোন শাহিদাও অন্ত:সত্ত্বা ছিলেন।
কিন্তু ধরেই নেয়া যায় যে, ফারজানার চেয়ে শাহিদার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। পুনরায় শুনানিতে তারা খালাস পেযে গিযেছিলেন। কিন্তু দেশটিতে বিচার প্রক্রিয়া থেমে নেই। কাউকে না কাউকে বিচারের জন্য উদগ্রিব হয়ে আছে তথাকথিত এই আইন।
২০০২ সালে কোহাতের একটি জজ আদালত জাফরান বিবি নামের এক নারীকে অভিযুক্ত করে ব্যভিচারের দাযে এবং তাকেও পাথর ছুঁড়ে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। বিচারের দণ্ড এক্ষেত্রে এককাঠি সরেস ছিল। বিচারকরা জাফরান বিবির গর্ভাবস্থাকে ব্যভিচারের ফসল হিসেবে চিহ্নিত করতে সফল হন। যদিও জাফরান বিবির বক্তব্য ছিল এক্ষেত্রে ভিন্ন। তিনি বলেছিলেন, স্বামী কারাগারে থাকা অবস্থায় তার ভাই তাকে ধর্ষণ করেছিল, কিন্তু তিনি শারীরিকভাবে ধর্ষণের সময় প্রতিরোধ করেছিলেন কিনা তা প্রমাণ করতে পারেননি বলে জাফরানের দাবি উপেক্ষিত থেকে যায়।
কিন্তু এক্ষেত্রেও আদালতের প্রথম রায় অন্যান্য অনেক কারণ শেষপর্যণ্ত উল্টে যায়। বেঁচে যান জাফরান বিবি। কিন্তু বার বার এ ধরনের রায় এটিই প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের চলতি আইন অনুসারে নারীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা যায়।
রাষ্ট্র যদি পাথর ছুঁড়ে মারার নির্দেশ দিতে পারে, তাহলে জনগণ তো আর পেছনে পড়ে থাকতে পারে না। আর এটাই ঘটেছে ফারজানা পারভিনের বেলায়। তার ওপর হামলার আগে, ইট মেরে তাকে থ্যাতলে দেয়ার আগে পর্যণ্ত ফারজানা বিশ্বাস করেছিলেন যে, রাষ্ট্র তার কথা শুনবে, আদালত তা আমলেও নিয়েছিল, এমনকি ন্যায়বিচারও পেতে পারতেন ফারজানা। কিন্তু তার আগেই পরিবার নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ায় ফারজানার আর সেই পথ খোলা থাকেনি।
যদিও ফারজানা অনেক কিছুই জানতেন না দেশের আইন সম্পর্কে, আইন কতটা নিষ্পেষিত করে রাখছে নারীদের। শুধু তাই নয়, দেশের কানুন ই শাহাদাত অধ্যাদেশেও নারীরা উপেক্ষিত। মামলার ক্ষেত্রে নারীদের সাক্ষ্য একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তির সাক্ষ্য নয়, জিনা এবং হুদুদ অধ্যাদেশ এখনও বিদ্যমান, যেখানে নারীকেই ধর্ষণের প্রমাণ দিতে হয়।
২০০৬ সালে ওমেন্স প্রটেকশান অ্যাক্টের অধীনে কিছু সংশোধনী আনা হলেও ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তা দেশটির কেন্দ্রীয় শরীয়া আদালতে অসাংবিধানিক বলে ঘোষিত হয়। ২০১১ সালের ২২ জুন পর্যন্ত জাতীয় অধিবেশনে এটির সংশোধন আনার কথা থাকলেও কার্যত তা হয়নি। ফলে যা ছিল, তাই আছে। ধর্ষণের অভিযোগ আনা নারীকেই তাই এখন পর্যন্ত পাথর ছুঁড়ে মারার নির্দেশ দেয়া হয়।
ফারজানা আসলে আগেই মরে গিয়েছিলেন। তাকে হত্যার আগে থেকেই তিনি ছিলেন মৃত। কারণ তিনি নিজেকে পাকিস্তানি নারী হিসেবে ভাবার পাশাপাশি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছিলেন। যে দেশে তিনি জন্মেছিলেন, যেখানে তিনি নি:শ্বাস নিতেন, এবং যেখানকার সিস্টেমের কাছে তিনি নিরাপদ স্বর্গ দাবি করেছিলেন, মূলত এসবই ছিল ভ্রান্ত।
ফারজানাকে হত্যার পর এখন তা নিয়ে নানান কথা হচ্ছে, ক্ষোভের কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু বিষয়টা আসলে পরিবারের সম্মান বা পুলিশের নির্লিপ্ততাও নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে, পাকিস্তান একটি দেশ হিসেবে পাথর ছুঁড়ে মারার মতোন শাস্তি আইনে রাখতে পারে, কি না! প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও পূর্বসুরিদের মতোনই ‘তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ’ নেয়া এবং এ সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করতে প্রধানমন্ত্রীর উচিত ‘সম্মানজনক হত্যা’র নামে হত্যাকাণ্ডের অবসান ঘটানো, সেজন্য যা যা করা উচিত, যে পদক্ষেপ নেয়া উচিত, তাই করা। জাতীয় অধিবেশনে এ সংক্রান্ত সংশোধনী পাস করে আইন বই থেকেই এ ধরনের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিধান উঠিয়ে নিতে হবে এক্ষুণি।
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি দেশের রাস্তায় রাস্তায় নারীদের নিয়ম শেখানো, ধর্ষণ করা, হত্যার ধান্দায় অপেক্ষমান জনতার উদ্দেশ্যে কিছু উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে ফারজানার মতোন পাকিস্তানি মেয়েদের জীবন কিছুটা হলেও মোড় নিতে পারে।