আমরা যারা একলা থাকি-২৪

imp 1সুপ্রীতি ধর: মাত্র কয়েকদিন আগেই জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। তাঁর এমন বিয়োগ যাত্রা বিষন্ন করে রেখেছিল সারাদেশ, সারাবিশ্বের বাংলা ভাষীদের। মনিকাও তার ব্যতিক্রম নয়। ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছিল অপূরণীয় এই ক্ষতিতে, যেমন সাহিত্যে, তেমনি সংস্কৃতি জগতেও।

এর আগেই হঠাৎ করে বিদায় নিয়েছেন আরও দুই দিকপাল, চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক-সাংবাদিক মিশুক মুনীর। মনিকা তখন রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। ওই দুজনের মৃত্যু তার ভিতরে ক্ষোভ জাগিয়েছিল তা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না বলে।

কিন্তু হুমায়ূন? তিনি তো অসুস্থ হয়ে চলে গেলেন। এমনভাবে কাঁদিয়ে গেলেন জাতিকে। দেশ কাঁদছে, পাঠক-ভক্তরা কাঁদছে। মনিকাও থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আহা, কী এমন ক্ষতি হতো লোকটি বেঁচে থাকলে?

এরই ১০দিনের মাথায়, এমনই এক শোকবিহ্বল সকালে একটি ফোন আসে। প্রথমে ঘুমের ঘোরে ফোনটি সে ধরে না। দ্বিতীয়বার ধরেই মাথাটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসে। কান ঝা ঝা করে উঠে। ভুল শুনছে না তো! অপর প্রান্ত বলে, ‘আফা, খবর পাইছুইন? অমুক ভাই তো নাই, মারা গেছে’। মনিকা মাত্র কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করে, কখন, কিভাবে? অপর প্রান্ত বলে, ‘অতকিছু জানি না, পাড়ায় মাইক মারতেছে, শুইনা আমার ভাই আমারে জানাইছে। আমি আফনেরে জানাইলাম’। আচ্ছা, বলে ফোনটা রেখে দেয় মনিকা।

কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখে মনিকা। ভুল শোনেনি তো, স্বপ্ন দেখেনি তো! এমন একটি খবর যদি কোনদিন সত্যি না হতো! হঠাৎই মনে পড়লো, আচছা, কে যেন মারা গেছে আকলিমা বললো? যে মানুষটা মারা গেছে সে পাড়ার দোকানে চা খেতে আসা লোকগুলোর কোনো একজন? সে দেখতে কেমন হয়েছিল? অনেক বছরের ব্যবধান। মানুষ বেঁচে থাকলে বয়স বাড়ে। কিন্তু কতোই বা বয়স হয়েছিল লোকটার? ৪৯ মাত্র? এটা কি চলে যাওয়ার সময় ছিল? আচ্ছা, মারা যাওয়ার সময় কী হয়েছিল তার? শেষমূহূর্তে তার কার কথা মনে হয়েছিল? কাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল?

মনিকা জানে, এসব প্রশ্নের উত্তর সে আর কখনও পাবে না। যে উত্তরগুলো দিতে পারতো, সেই তো আজ সকালে মাইকের ইথারে শোক সংবাদ হয়ে গেছে! মনিকার বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসে। কিন্তু কার জন্য এই কান্না? যে লোকটার সাথে তার অনেক দিন, অনেক বছর কোন যোগাযোগ ছিল না, তার জন্য? যে লোকটা তার সন্তানের দায়িত্ব কোনদিন নেয়নি, বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে চলে গেছে নির্দ্বিধায়, তার জন্য? যে লোকটার জন্য সমাজের ভ্রুকুটিই মেনে নিয়েছিল একদিন মনিকা, সেই লোকটার জন্য কাঁদছে আজ সে?

জীবন বড়ই বিচিত্র আসলে। বেঁচে থাকলে যে মানুষটাকে তার শত অন্যায়ের জন্য ক্ষমা করা যায় না, সেই মানুষটাই যখন নাই হয়ে যায়, তখন কী অনায়াসে ক্ষমা করে দেয়া হয়? দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা তখন বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের মতোনই সুন্দর-প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। কী আশ্চর্য!

মনিকা তার ঘুমিয়ে থাকা ছেলেকে খবরটি দেয় কান্নায় ভেঙে পড়ে। ১৬ বছরের কিশোর মনে তখন কি কোনো ঝড় বয়ে গেছিল? জানা হয় না। কাঁথা দিয়ে মুখটা ঢেকে নি:শব্দে শুয়ে থাকে ছেলে। একটু পর দেখা যায়, কাঁথার ভিতর থেকে শরীরের ত্বরিৎ উঠানামা, সঙ্গে গোঙানির শব্দ। মনিকা নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে সে। চিৎকার করে কাঁদে। একটু থিতু হয়ে দেখে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, এক্ষুণি বেরিয়ে পড়তে হবে। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ, মাইলের হিসাবে তেমন দূরে নয়, কিন্তু রাস্তার হিসাব আলাদা। সেইসাথে আছে যানবাহনের হিসাব।

কয়েকটি ফোন করে মনিকা। অফিসকে জানায়। বড় বোনকে, ভাইকে ফোন করে খবরটা দেয়। সাথে জানতে চায়, তার কী যাওয়া উচিত! বোন সাথে সাথেই বলে, হ্যাঁ, ছেলেকে নিয়ে যাও। ভাইটা একটু দ্বিধায় পড়ে। এতো বছরের গ্যাপ, যদি অপমান করে বোনকে! তারপরও সে তার গাড়িটা পাঠিয়ে দেয়। বলে, যাও ঘুরে আসো।

খুব বেশি সময় নেয় না তৈরি হতে। একটা ছোট হাতব্যাগ গুছিয়ে নেয়। ছেলেকে নিয়ে রওনা দেয় ভীষণ পরিচিত পথে, অপরিচিত একটা মন নিয়ে। আশংকা, কষ্ট, সব মিলেমিশে আজ একাকার হয়ে গেছে। পথে যেতে যেতে দেশের বাইরে থাকা মেয়েকে জানায়, ‘মা, বাবার প্রতি কোনরকম অভিমান-ক্ষোভ থাকলে ক্ষমা করে দিও’।

মেয়ে চিৎকার করে উঠে, ‘কেন, কী হয়েছে’?

‘বাবা আর নেই’।

মেয়েটা ঠাস করে ফোনের লাইন কেটে দেয়। মনিকা চোখের সামনে দেখতে পায়, মেয়েটা এখন বিদেশের মাটিতে বসে কী করছে? ওকে কাঁদতে দেয় সে। কিছু কিছু সময় কান্নাটা খুব জরুরি হয়ে পড়ে, মনের ভিতরের সব কষ্ট তখন জল হয়ে বেরিয়ে আসে, এটা না হলে মানুষ বাঁচতে পারতো না।

গাড়ি ছুটে চলেছে। মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছে মনিকার। কত স্মৃতি, কত কথা সব আজ মনে পড়ে যাচ্ছে। কোনো দরকার ছিল না। একের পর এক ফোন আসতে থাকে, মেসেজ আসে। লোকটার বাড়িতে কথা বলেছিল মনিকা। মেজো ভাইয়ের বউ শুধু বলেছিল, ‘তুমি আসবে না শেষ দেখা দেখতে?’ শেষ দেখা শব্দটা মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করে মনিকা। আরেকটা কথাও বলেছিল সে, ‘এতো যে প্রেম ছিল তোমাদের, যাও, আজ থেকে সব শেষ হয়ে গেল’। কথাটা বুকের ভেতর আছড়ে-পিছড়ে পড়ে মনিকার। 

হমম, অনেক প্রেম ছিল। কৈশোরের প্রেম। চিঠি লেখার প্রেম। গোপনে চিঠি ছুঁড়ে দেয়া, লুকিয়ে লুকিয়ে তা পড়া আর একটুখানি দেখাই ছিল সেই প্রেম। কী দারুণ সেই অনুভূতি!

আজকের এই যাত্রা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই কৈশোরে। উঠতি বয়সে যখন যাকে-তাকে ভালো লেগে যায়, চারপাশের সবকিছুকে অসম্ভব সুন্দর লাগে, তখনই কোনো একদিন দেখা হয়েছিল লোকটার সাথে। সেও তখন কিশোর ছিল। একটু-আধটু দাড়ি-গোঁফ গজাচ্ছে তখন। কথা বলতো মুখে হাত দিয়ে, যেন গোঁফ বেরিয়ে যাবে। প্রচণ্ড জোর সাঁ সাঁ করে মোটর বাইক নিয়ে বাসার সামনে দিয়ে দিনে কয়েক শ বার যেতো আর আসতো। মনিকার বাসার সবার দৃষ্টি তখন মনিকার দিকে। সবাই জানতো এই বাইকের শব্দ। মধ্যরাতে যখন সবাই ঘুমে অচেতন, তখন রাস্তায় কারও পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যেত মনিকার। ভাবতো, কীরে বাবা, ছেলেটার কী ঘুম-টুম বলে কিছু নেই? মধ্যরাতেও বাসার সামনে হাজির?

ভাবনাটা তাকে কাবু করে ফেলতে চায়, কিন্তু না, শক্ত তাকে থাকতেই হবে। আজ আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না কিছুতেই। অনাগত জীবনের পথ ফেলে আসা পথের চেয়ে কোন অংশেই কম না। এ পথ তাকে পাড়ি দিতেই হবে। লোকটা চলে গেছে, প্রচণ্ড এক অভিমান কাজ করে মনিকার। এতোদিন যার সাথে তার কথা না হলেও, দেখা না হলেও রাগ-ক্ষোভের সম্পর্ক ছিল, হঠাৎই সেই স্থানটা শূন্য বোধ হয়। রাগ-ক্ষোভেরও তাহলে একটা শারীরিক রূপ আছে! অশরীরী মানুষের সাথে তা যায় না। তাদের জন্য ক্ষমাই তখন একমাত্র উপায়।

গাড়ি নিয়ে সোজা গ্রামের পথে ছুটে যায়। খবর আসে, জানাজা শেষে লাশ, হ্যাঁ, লোকটা তো আজ স্রেফ একটা লাশ, তা নিয়ে যাওয়া হয়েছে গ্রামে। আছরের পর দাফন হবে। বাড়ি থেকে কয়েকজন এগিয়ে আসে তাদের নিতে। পুরো পথ গাড়ি যাওয়া সম্ভব না। তাই নেমে হেঁটে এগিয়ে যায় মনিকা ও তার কিশোর ছেলে। পায়ে যেন রাজ্যের ভার আজ। চলতে চায় না। সামনেই হয়তো বাড়িটা, বেশ কিছু গাড়ি দেখা যাচ্ছে, মানুষের কথাও কানে আসছে। আসছে কান্নার শব্দ থেমে থেমে। লোকটার জন্য কি তাহলে কান্নার মানুষও আজ নেই? যাদের কাছে ফিরে এসেছিল সে স্ত্রী-সন্তান ফেলে, তারা কি এতোটাই অকৃতজ্ঞ? মরণেও কাঁদবে না?

সামনেই একটা খাটিয়া দেখা যাচ্ছে। মনিকা হতভম্বের মতোন দাঁড়িয়ে পড়ে। একজন কাকীমা এসে তাকে ধরে ধরে নিয়ে যায় ওই খাটিয়ার কাছে। বলেন, ‘মা, দেইখ্যা লও শেষবারের মতোন’। মনিকার চোখে এখন আর জল নেই। মন শক্ত করে আছে। স্বাভাবিকভাবেই মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে মুখটা দেখে, নির্লিপ্ত ঘুমে অচেতন মানুষটা। সংসারের কোনো ঝামেলা তাকে পায়নি। তবে শান্তিতে ছিল কিনা, তা আর জানা হয়ে উঠে না মনিকার। শিয়রের কাছে বসে থাকা ছেলেটাকে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি কি একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারি’? উত্তরে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় সে। মনিকা হাতটা কপালে ছোঁয়ায় মানুষটার। স্পর্শ পেতে চায়, চেনা স্পর্শ। কিন্তু হায়, সময়ের স্রোতে স্পর্শও আজ তার অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে। এ যে কেবলই একজন মানুষ! মুখ দেখা শেষ হলে পা বাড়ায় সামনে। ওখানে অনেক মানুষের ভিড়। কোথা থেকে লোকটার ছোট ভাই এসে জড়িয়ে ধরে মনিকাকে। ভীষণভাবে কাঁদছে সে আর বলছে, ‘সেই তো এলে, বড্ড বেশি দেরি করে’। মনিকা শুধু সান্ত্বনা দেয়। সে জানে, গ্রামের কয়েকশ চোখ এখন তাকে ঘিরে রেখেছে।

আস্তে আস্তে একটা ঘরের বারান্দায় উঠে আসে সে। ওখানে কারও মাথায় জল ঢালা হচ্ছে। লোকটার ছোট বোন। চিৎকার করছে, আর থেমে যাচ্ছে নিস্তেজ হয়ে। মনিকার এই কান্না খুব পরিচিত। এই মেয়েটা এভাবেই কাঁদে। মনিকাকে পেয়ে সে জাপটে-খামচে ধরে। মনে হয়, সে যেন তার দাদাকেই ফিরে পেয়েছে মূহূর্তের জন্য। লোকটার কিছু বন্ধুও এসেছে খবর পেয়ে। ওদেরই একজন ভিড় ঠেলে মনিকার দিকে এগিয়ে আসে। এতোক্ষণে মনিকার ভিতরে জমে থাকা মেঘ জল হয়ে ঝরে পড়ে। সেই বন্ধুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মনিকা নিজেকে আর সামলাতে পারে না। হাউ মাউ করে উঠে বন্ধুর বুকের কাছে।

জানাজা শেষে মনিকার কাছে অভিভাবক কয়েকজন এসে দাবি উঠিয়ে নেয়ার কথা বলেন, ক্ষমা করে দিতে বলেন। সেই মূহূর্তে মনিকা আঁতিপাতি করেও খুঁজে পায় না অপরাধগুলো। সে সবার সামনে ক্ষমার ঘোষণা দিলে তারা উঠে যান লাশ নিয়ে। ছেলে গিয়ে লাশ কাঁধে নেয় অনায়াসেই। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই সে নূহাশকে বাবা হুমায়ূন আহমেদের লাশ নিতে দেখেছে টেলিভিশনে। এবার তার পালা। কবরে প্রথম মাটিটিও সেই দেয়। বড় হয়ে কোনদিন বাবা বলে ডাকতে না পারলেও, আজ কী সুন্দর করে সব দায়িত্ব সে পালন করে যাচ্ছে! সম্পর্ক এমন একটা জিনিস, যা শতবার ধুয়েও মুছে ফেলা যায় না। সম্পর্ক থেকে যায়।

কবর দেয়া শেষ, সবাই চলে যাচ্ছে। মনিকা তখন সাহস করে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় সেদিক। লোকটার ছোটবেলার আরেক বন্ধু তখন ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, ‘বৌদি, বিশ্বাস করেন, ও আপনাকে খুব ভালবাসতো, কোনদিন অবিশ্বাস করেনি আপনাকে’।

মনিকা তখন শুধু একটি কথাই বলে, ‘যে মানুষটা সব দায়িত্ব অস্বীকার করে কাপুরুষের মতোন চলে গেল তাকে একলা ফেলে, এখন আর এগুলো বলে লাভ কী?’ নিজের কানেই বাজতে থাকে শেষ শব্দটা….লাভ কী??? (চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.