উইমেন চ্যাপ্টার: মায়া অ্যাঞ্জোলো বলতেন, ‘কারও মেঘাচ্ছন্ন আকাশে রঙধনু হওয়ার চেষ্টা করো’।‘ সাহস হচ্ছে সকল গুণের মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সাহস ছাড়া তুমি অন্য কোন গুণেরই ধারাবাহিক অনুশীলন করতে পারবে না’।
যে মানুষটি জীবনভর তাঁর সাহিত্যকর্ম, অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অন্যের আকাশে রঙধনু হওয়ার সফল চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, সেই তিনিই বার্ধক্যের কাছে হার মেনে চলে গেছেন ৮৬ বছর বয়সে। তবে যে জীবন তিনি যাপন করে গেছেন, তার তুলনা অপরিসীম। বিশেষ করে, বিশ্বজুড়ে যারাই আজ অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের অন্যতম অনুপ্রেরণা হয়েই থাকবেন যুগ যুগ ধরে। এখানেই তাঁর আসল সাফল্য।
আফ্রো-আমেরিকান এই লেখক, কবি এবং অ্যাক্টিভিস্টের মৃত্যুতে তাই বলতে শোনা যায়, জ্ঞানের জগতে, চেতনার জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। ওপরের ওই একটি বাক্যেই উপলব্ধি হয় যে, কী ছিলেন তিনি, কেমন ছিলেন, কিসের জন্য লড়েছেন, সব।
মায়া অ্যাঞ্জেলোর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে সাতটি আত্মজীবনী, তিনটি রচনামূলক বই এবং বেশকটি কবিতার বই। এছাড়া ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাটক, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন শো, এসবই তাঁর ঝুলিতে।
১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল তিনি জন্ম নেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির সেন্ট লুইসে। আর মারা গেলেন ২০১৪ সালের ২৮ মে। জীবনে বিয়ে করেছেন তিনবার। ১৯৫১ সালে তিনি বিয়ে করেন এনিস্টাসিয়াস টশ অ্যাঞ্জেলোসকে। বিয়েটা ভেঙে যায় ১৯৫৪ সালে। এরপর ১৯৬০ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন ভুসুমজি মেইককে। এই বিয়েও টেকে মাত্র তিন বছর। ১৯৭৩ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতোন গাঁটছড়া বাঁধেন পল ডু ফিউয়ের সাথে। ১৯৮১ সাল পর্যণ্ত তাঁরা একসাথেই ছিলেন।
প্রেসিডেন্সিয়াল মেডাল অব ফ্রিডম ছাড়াও আরও অনেক অ্যাওয়ার্ড পান মায়া।
মায়া অ্যাঞ্জেলো এমনভাবে জীবনযাপন করেছেন যেন তাঁর আগামীকাল বলে কিছু নেই। বর্তমানে তিনি বেঁচে গেছেন আমৃত্যু। বর্তমানকে নিয়েই তাঁর পথচলা, কর্ম।
তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষক, শিল্পী, এবং সর্বোপরি মানুষ। সমতার জন্য, সহিষ্ণুতার জন্য, শান্তির জন্য তিনি লড়ে গেছেন শেষদিন পর্যন্ত, শারীরিক অসুস্থতার কাবু করতে পারেনি তাঁকে। তাইতো তাঁকে মেধাবী রেনেসাঁ নারী হিসেবে উল্লেখ করা হয় সবখানে।
তাঁর ভাষায়, নাইন-ইলেভেন ছিল একটি ‘ঘৃণ্য অপরাধ’। তিনি বলেন, সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে বসবাস করা আমেরিকার অনেক সাদা চামড়ার মানুষের জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা, কিন্তু কালো মানুষেরা এর সাথে বাস করছে চারশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
দিন যতই যাচ্ছিল, স্বাস্থ্যও খারাপ হচ্ছিল তত দ্রুত। একবার এক সাক্ষাতকারে তিনি বলছিলেন, আমি আমার ৮১ বছর বয়সের সাথে লড়াই করছি। আশা করছি আসছে বছর এই লড়াই চলবে ৮২ বছরের সাথে। তবে এর চেয়ে বেশি দূর যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু এ নিয়ে কোন পরিকল্পনাও নেই আমার। যতদিন সম্ভব কাজ করে যাবো। আমি ‘গ্রীষ্মকালীন ওয়াইন’ এর মতোই ভাল আছি।
অপরাহ উইনফ্রে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মায়া অ্যাঞ্জেলোকে আমি আমার কুড়ি বছর বয়স থেকেই পরামর্শক, মা/বোন, এবং বন্ধু হিসেবে পেয়ে ধন্য। তিনি আমার জন্য সবসময়ই ছিলেন। আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে তিনি আমার পাশে ছিলেন। বিশ্ব তাঁকে একজন কবি হিসেবে জানে, কিন্তু হৃদয়ের দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। ‘যখন তুমি শিখবে, শেখাবে, যখন কিছু পাবে, দেবেও’- এটা ছিল তাঁর কাছ থেকে পাওয়া আমার সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
মায়া অ্যাঞ্জেলো তিনটা গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, ছয়টা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় কবি, যে কিনা তাঁর কবিতা পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তবে মায়া অ্যাঞ্জেলো সম্পর্কে সবচেয়ে যে জিনিসটা আমাকে বেশি নাড়া দেয় তা তিনি কি লিখেছেন, বা কি করেছেন বা কি বলেছেন, তা নয়, কিভাবে তিনি তার জীবনটা কাটিয়েছেন, সেটাই আমাকে বিস্মিত করেছে। তিনি বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন অত্যন্ত স্থিরতার সাথে, বিশ্বাস এবং স্বাভাবিকতার সাথে। আমি তাঁকে ভালবেসেছিলাম এবঙ আমি জানতাম, তিনিও আমাকে ভালবাসেন। সারাজীবন আমি তাঁকে মিস করবো। তিনি আমার মেঘাচ্ছন্ন আকাশে সারাজীবন রঙধনু হয়েই থাকবেন।
মায়া অ্যাঞ্জেলোর কিছু বিখ্যাত উক্তি:
- কাউকে কখনও প্রাধান্য দিও না, যখন তোমরা নিজেরাই তার কাছে ‘একজন অপশন’।
- কোনকিছু পছন্দ না হলে তা বদলে ফেল। যদি বদলাতে না পারো, তাহলে নিজের প্রবৃত্তিকে বদলাও। কিন্তু অভিযোগ করো না।
- নিজের ভেতরে না-বলা গল্প বয়ে বেড়ানোর চেয়ে বড় দু:খ আর কিছু হতে পারে না।
- যে মানুষ নিজেকে ভালবাসে না, অথচ আমাকে বলে, ‘তোমাকে ভালবাসি’, সেসব মানুষকে আমি বিশ্বাস করি না। আফ্রিকায় একটি কথা চালু আছে, কোনো উলঙ্গ ব্যক্তি যদি আপনাকে শার্ট দিতে চায়, তার থেকে সাবধান থাকুন।
- আমরা প্রজাপতির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই, কিন্তু আমাদের মধ্যে কম জনই আছেন যারা প্রজাপতির এই সৌন্দর্য পেতে কি ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা স্বীকার করে।
- আমি জীবনে শিখেছি যে, লোকজন ভুলে যাবে কি তুমি বলেছো, কি তুমি করেছো, কিন্তু তারা কখনই ভুলবে না, তুমি তাদের কি অনুভব করিয়েছো।
- আমার জীবনের লক্ষ্য শুধুই বেঁচে থাকা নয়, সাফল্যের সাথে বেঁচে থাকা। আর তা করতে হবে কিছুটা আগ্রহ, কিছুটা সমবেদনা, কিছুটা হাস্যরস, এবং কিছুটা স্টাইলের সাহায্যে।
- পরিবারের ভালবাসা, ব্যক্তির ভালবাসা সব ভুলিয়ে দিতে পারে। বৃহত্তর সমাজ যে ক্ষত তৈরি করে, এই ভালবাসা তাও সারিয়ে তুলতে পারে।
- আমি দেখতে ভালবাসি যখন কোন ইয়ং মেয়ে বাইরে যাচ্ছে, কলার ধরে বিশ্বকে করায়ত্ত করছে। তোমাকে বাইরে বের হতে হবে এবং গাধাকে লাথি মারতে হবে।
- নিজে যতক্ষণ না কিছু করছো, ততক্ষণ কোন কাজই হবে না।
- ক্ষমা হচ্ছে নিজের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। সবাইকে ক্ষমা করে দাও।
বি. দ্র. মায়া অ্যাঞ্জেলোর মৃত্যুতে উইমেন চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে তাঁর আত্মার প্রতি শান্তি কামনা করছি। :-সম্পাদক