রোজ নামচা- ১৮

Black womenলীনা হক: দিন কয়েক আগে বাসায় ফেরার পথে অনেকটা সময় আটকে ছিলাম কাকলী ট্রাফিক সিগন্যালে। রাত তখন প্রায় ১১টা। কিন্তু ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ির বিশাল বহরে মনে হচ্ছিলো যেন বা অফিস ফেরত সময়।

ড্রাইভার জানালো, এই বিশাল বহর একবারে সিগন্যাল ক্রস করতে পারবে না, দুইবার লাগবে। বিরস মনে বসে থাকি, সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। ঢাকা শহরের ট্রাফিক মোড়ে ভিক্ষুকদের উপদ্রব (!) সবারই জানা। আমার গাড়ির জানালার কাঁচে টুকটুক করছেন যে ভিক্ষুক নারীটি, তাঁর বয়স প্রায় ৬০ তো হবেই। এতো রাতেও একজন বর্ষীয়ান নারীকে ভিক্ষা করতে দেখে বুকের ভিতর কেমন করে উঠলো। তখন আবার টিপটিপ বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। বুঝে উঠে পাই না কেন পৃথিবীর এই বৈষম্য- একজন বর্ষীয়ান মানুষকে কোন পরিস্থিতিতে এতো রাতে বৃষ্টির মধ্যেও অন্যের দয়া চাইতে হয়!

ভাবতে ভাবতেই অন্যদিকের জানালায় জোরে জোরে ঠকঠক! তাকিয়ে দেখি আরেক মধ্যবয়সী নারীর মুখ। আমি ঘাড় ঘুরাতেই সে চট করে ৬/৭ বছরের একটি ছেলেকে খাড়াভাবে কোলে তুলে আমাকে দেখাচ্ছে। শিউরে উঠে দেখি শিশুটির খুব সম্ভবত হার্নিয়া। তার জননেন্দ্রিয়ের নিচের অংশ ফুলে আছে একটি টেনিস বলের আকৃতিতে। ঝটকা দিয়ে তোলার কারণে সে হয়তো ব্যথা পেয়েছে, চিৎকার করে উঠলো শিশুটি, জল গড়িয়ে পড়ছে তার চোখ দিয়ে। মুহূর্তের জন্য বিবশ হয়ে গেলাম যেন।

তারপরেই জানালা খুলে শিশুটির মাকে বললাম কবে থেকে এই অবস্থা? চিকিৎসা করাচ্ছে না কেন? বলতে বলতেই টের পেলাম কি অদ্ভুতভাবে বোকার মতন প্রশ্ন করছি আমি। যে মাকে খাওয়ার জোগাড় করতে রাত ১১টার সময় অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে ভিক্ষা করতে হয়, সে আর কোনও কথা ভাববে কেমনে? কিছু টাকা দিবো বলে ব্যাগে হাত দিচ্ছিলাম, এরই মধ্যে সিগন্যাল বাতি সবুজ হয়ে আমার গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমি নারীটিকে ইশারা করলাম গাড়িতে উঠে বসতে। আমার ড্রাইভার চরম বিরক্ত আমার উপরে, আপা, উঠাইয়েন না গাড়িতে। এরা ইচ্ছা করে ভিক্ষা করে, এই বাচ্চা ওর নিজের না।

এদিকে পিছন থেকে গাড়ি বহরের লাগাতার হর্নের শব্দে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। ট্রাফিক সার্জেন্ট এগিয়ে এসে জানতে চাচ্ছেন কি সমস্যা আমাদের! ভিক্ষুক নারীটি আমাদের ছেড়ে অন্য গাড়ির কাছে চলে গেছে। চরম ক্যাওয়াস। ড্রাইভারকে বললাম, সিগন্যাল পেরিয়ে গিয়ে গাড়ি সাইড করতে। কপাল কুঁচকিয়ে ড্রাইভার গাড়ি সামনে এগিয়ে নিয়ে রাখল। আমি নেমে উল্টোদিকে হেঁটে এলাম নারীটির সাথে কথা বলার জন্য। এগিয়ে গিয়ে আর খুঁজে পাই না তাকে। বৃষ্টিও জোর হয়েছে।

ট্রাফিক সার্জেন্ট আবার এগিয়ে এলেন, ম্যাডাম, কি সমস্যা? বললাম তাকে। হাসলেন সার্জেন্ট, ‘আরে ম্যাডাম, এরা হইল পেশাদার ফকির। আর দেখেন গিয়া ওই বাচ্চাও হয়তো ওর নিজের না! বৃষ্টির মধ্যে না ভিজে বাসায় চলে যান।’ আমার তখন জেদ চেপে গেছে আর কিছু না হোক শিশুটি ওই নারীর নিজের সন্তান কিনা এটা জানতেই হবে। দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করা যায়, এর মধ্যে দেখি নারীটি শিশুটিকে নিয়ে রাস্তার উল্টোদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে রেল লাইনের দিকে। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ধরলাম তাকে। প্রথমে সে খুবই বিরক্ত। আমার কোনও কথারই উত্তর সে দিবে না।

‘এইসব আজাইরা প্যাঁচালে লাভ কি? কিছু দিলে দ্যান, না দিলে ফুটেন’। শিশুটি মার কোলে উঠতে চাইছে, কিন্তু কোলে নিলেই সে ব্যথা পায় বলে মা কোলে নিচ্ছে না এতে তার কান্না আরও বেড়ে গেল। খপ করে নারীটির হাত ধরে ফেলি আমি। এতে সে কিছুটা বিহবল হয়ে পড়ে। জানতে চাই কে এই শিশুটি? কতদিন ধরে এই অবস্থা? কোথায় তারা থাকে? চিকিৎসা করিয়েছে কিনা?

জানলাম আমারই প্রতিবেশী বলা যায়, বনানী লেকের পাশে থাকে। আরও দুটি সন্তান আছে তার। শেরপুরে গ্রামের বাড়ী। ঢাকায় এসেছে প্রায় বছর চারেক। চতুর্থ সন্তান পেটে রেখে স্বামী ফেলে গেছে কোথায় কে জানে। পরে মৃত সন্তান জন্ম দেয় সে। স্বামীর কোনও খোঁজ জানে না। দিনে দুটি রেস্তোরায় কুটনা কোটা আর মশলা বাটার কাজ করে, বড় সন্তান দুটি (একটির বয়স ১১ আর একটি ৯- দুটি মেয়ে) বনানী কাঁচা বাজারে সবজি টোকায়, কাগজ টোকায়, সন্ধ্যার পরে সে এই অসুস্থ ছেলেটিকে নিয়ে কাকলী মোড়ে ভিক্ষা করে, শুক্রবারে বনানী গোরস্থানে যায় ভিক্ষা করতে। নারীটির প্রথম সন্তানটির একটি পায়ে জোর নাই, খুঁড়িয়ে হাঁটে (মানে কি পোলিও হয়েছিল? বাংলাদেশ না পোলিও মুক্ত দেশ!), তার দ্বিতীয় সন্তানটি পাগলী, কথা বলতে পারে না ঠিকমতো, মুখ দিয়ে শব্দ করে, শুনে বুঝলাম হয়তো মেয়েটির কিছুটা ডিসএবিলিটি/ অটিজম আছে।

সবাই বলে নারীটির উপরে জিনের কু-নজর আছে তাই তার সবগুলি সন্তান কোনও না কোনও ভাবে ‘পোকায় খাওয়া’। হ্যাঁ, এই শব্দটিই ব্যবহার করে নারীটি। পিতা অসুস্থ সন্তানদেরকে বোঝা ভেবে ফেলে গেলেও মা তো পারে না সেটা করতে। ছেলেকে একবার দেখিয়েছিল ডাক্তার মহাখালীর কোনও হাসপাতালে, ডাক্তার বলেছে অপারেশন করা লাগবে। ভাতই জোটে না, চিকিৎসার টাকা কোথা থেকে জোগাড় করবে? মাঝে মাঝে শিশুটির হার্নিয়া ফুলে উঠে বেশী সেই সাথে জ্বরও হয়, তখন ব্যথায় বাচ্চাটি কাঁদে। ওষুধের দোকান থেকে প্যারাসিটামল কিনে খাইয়েছে কয়েকবার। জিজ্ঞ্যেস করলাম, যদি ছেলেটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়? অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে মা’টি। ভাবে হয়তো প্রায় মধ্যরাতে এই নারীর কি মাথা নষ্ট হল! বা হয়তো ভাবে বড়লোকি খেয়াল!

আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে তাকে বলি পরদিন অবশ্যই আমার সাথে দেখা করতে। রাখলো সে ঠিকানাটা। আমিও তার ঝুপড়ির একটা মোটামুটি লোকেশন ধারনায় নিলাম। আসবে বলল, সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোয় তার চোখে একটুখানি আশা যেন জেগে উঠে। অসুস্থ ক্লান্ত শিশুটি মাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। এদিকে ড্রাইভার অস্থির হয়ে উঠেছে। বার বার তাগাদা দিচ্ছে,’ আপা রাত অনেক হয়েছে।‘ ফিরে আসি গাড়িতে।

ড্রাইভার আমার বোকামিতে চরম হতাশ। এই মধ্যরাতে আমার এইসব কাণ্ডকীর্তির কোনও কুল কিনারা সে করতে পারছে না। সে কোনভাবেই বিশ্বাস করছে না যে এই শিশুটি ওই নারীর নিজের সন্তান। বললাম, না হয় নাই হলো তার নিজের ছেলে, কিন্তু বাচ্চাটি যদি সুস্থ হয়ে যায়, অসুবিধা কোথায়?

আমি জানি একজন শিশুকে সাহায্য করে আমি কোনও দেশোদ্ধার করে ফেলতে পারবো না। না পারবো সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের (সোশ্যাল সেফটি নেট) আওতায় এইসব ভাসমান ঘরছাড়া মানুষকে সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ঠাণ্ডা গাড়িতে বসে আমার চোখটা বন্ধ আর মাথাটাকে চিন্তাশূন্যও করতে পারি না যে। এ আমারই ব্যর্থতা!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.