উইমেন চ্যাপ্টার: কিছুদিন আগে একজন পাঠক ফোন করে বলেছেন,’ আপা, একলা থাকি’র পর্বগুলো পড়ে মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। একলা থাকা মানেই তো শুধু কষ্ট আর বিষণ্ণতা নয়। একলা থাকা নারী পুরুষের সাফল্য আর আনন্দের কথা বলুন আপা, যাতে একলা থাকা মানুষরা আপনার লেখা পড়ে মনে সাহস পায়।‘ কথাটা আমাকে খুব ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
একা থাকার মধ্যে, সে ইচ্ছে করেই হোক কি অবস্থার কারণেই এক ধরনের বিষণ্ণতা তো আছেই। কিন্তু এটাও সত্যি অনেক একলা থাকা মানুষ কত বড় হয়েছেন জীবনে। পরিপূর্ণ আনন্দে জীবন কাটিয়েছেন, মানুষের জন্য করেছেন অনেককিছু।
পাঠককে বুঝিয়ে বললাম ‘একলা থাকি’ আসলে একা থাকার কষ্টের কথা বলে না, আমরা বরং বলতে চাই একা থাকা মানুষদের প্রতি এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজের বিভেদ আর বৈষম্যমুলক আচরণ এই একা থাকা মানুষগুলো আর তাঁদের পরিবারকে কত ধরনের মানসিক কষ্টের মধ্যে ফেলে। এই কথাগুলো শেয়ার করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে, শিক্ষিত মানুষের মধ্যে একটুখানি জাগাতে চাই সেই বোধ, যে একা থাকা মানুষরা কোন ভিন গ্রহের প্রাণী নয়, নয় কোন অপরাধে অপরাধী।
তবে মনে মনে চিন্তা করলাম আমিতো তো আর সমাজ সংস্কারক নই। বলুকগে মানুষ যা ইচ্ছে, আর মাথা ঘামাব না। এখন থেকে একা থাকাদের সাফল্যকথাই লিখব। এই ভাবছি যখন তখন আবারো এমন কিছু টুকরো ঘটনা ঘটলো যে সাফল্যগাঁথা তোলা রইল পরের বারের জন্য, এইবারও আবারো আমাদের সমাজের মানসিকতার দারিদ্রের কথা আবার একবার না বলে পারছি না।
দিন কয়েক আগে প্রবাসী এক সাহিত্যিক বন্ধুর আগমন উপলক্ষে আরেক বন্ধু পরিবারসহ একত্র হয়েছিলাম। এই বন্ধু এবং তাঁর স্ত্রীটিও কবি এবং উদার সংস্কৃতিমনা। বেশ অনেকদিন পরে দেখা দুই পরিবারে। দুপুরের খাবার খেলাম একসাথে। তারপরে গল্প। এই গল্প সেই গল্প। এই বন্ধু পরিবারটি আমার নুতন বাসায় প্রথম এসেছে। ঘুরে ঘুরে ঘরদোর দেখা। আমি অবশ্য আমার গাছেদের দেখাতেই বেশী আগ্রহী। আমার বাসায় গাছগুলো ছাড়া (প্রায় ৫১টা গাছ) আর যে কিছু দেখাবার মতন নাই! আর আছে গর্ব করার মতন আমার ছেলে-মেয়ে, আমার আত্মার অংশ।
বাসা দেখা শেষ। বন্ধুপত্নী মন্তব্য করলো, আপনার বাসাটা বেশ গুছানো, ধুলো ময়লা নাই। গৃহকর্মীর কাজের প্রশংসা করলাম, কারণ সেইই সব দেখে শুনে রাখে। বন্ধুর স্ত্রী বলল,’ আপনারা মা মেয়ে দুইজন মানুষ অথচ কি সুন্দর সাজানো আর আমরা পরিবার থাকি কিন্তু বাসার বেহাল অবস্থা’! আমার প্রায় ভিরমি খাবার অবস্থা পরিবারের ডেফিনেশন শুনে। নিজের কানে শুনেছি তবু হেসে বললাম,’ কেন আমরা মা মেয়ে বুঝি পরিবার নই?’
চায়ে চুমুক দিয়েছিলাম, উত্তর শুনে গলায় চা আটকে গেল।‘ না, ঠিক তা নয়, তবে কোন পুরুষ মানুষ নাই তো’! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!
কিছুদিন আগে অতি প্রিয় একজন লেখক একটি লেখার প্রশংসা করলেন। সেই সাথে জানতে চাইলেন, এই একলা থাকি সিরিজটি কেন লিখি? আমি কি সত্যিই একলা থাকি? জানালাম আমার সন্তানরা আমার সাথে থাকে। বললেন, সন্তানরা ছাড়া? বললাম সত্যি কথাটাই যে সেই অর্থে একাই। লেখক বললেন, সন্তানদের বাবা যদি আমার সাথে না থেকে থাকেন তাহলে আমার আজকের এই প্রতিষ্ঠা আর সাফল্য দুইগুণ অভিনন্দনের দাবীদার।
লেখক কথাটি মন থেকেই বলেছেন কিন্তু আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত ভাবলাম, কেন একা নারীর সাফল্য দুইগুণ অভিনন্দন প্রাপ্য হবে? পুরুষের সঙ্গ ছাড়া নারী কি জীবনে প্রতিষ্ঠা সাফল্য পেতে পারে না? এটা ঠিক যে দুইজন মানুষ একসাথে সামনা করলে জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই পেরোনো একটু সহজ হয়তো হয়। কিন্তু ব্যক্তি মানুষটির সাফল্যের পিছনে তাঁর নিজের মেধা চেষ্টা পরিশ্রম আর কমিটমেন্টই মূল ব্যাপার। কোন একা পুরুষের বেলায়ও কি একই কথা বলি আমরা? সেই সাথে এটাও ভাবলাম যে আমার অভিজ্ঞতায় বরং দেখেছি স্বামীর নিষেধের বেড়াজালে অনেক মেধাবী নারীর পেশাগত জীবনের ইতি ঘটেছে।
কয়েকদিন আগে পরিচয় হলো আরেকজন অনেক বড়মাপের সাংস্কৃতিক ব্যক্তির সাথে। এটা সেটা কথার পরে যথারীতি সেই প্রশ্ন, স্বামী কোথায় আছেন? আপাতত কোন স্বামী নাই শোনার পরে বললেন, ‘সরি, আপনাকে বিব্রত করলাম। আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।‘
জানালাম দুঃখিত হওয়ার কিছু নাই কারণ এটি একটি সত্য ব্যাপার আর আমি মোটেও বিব্রত বোধ করি নাই। শুনলাম উনি বলেছেন আরেকজনকে,’উনার (আমার) নার্ভ অনেক শক্ত’। আমি প্রশংসা হিসাবেই নিলাম কথাটা। কিছুদিন আগে একটি ছেলের সাথে পরিচয় হল, লেখালেখির সূত্র ধরেই। ত্রিশের নিচে বয়স তরুণ এই ছেলেটিও লেখে। জানতে চাইল,’ দুলাভাই কি করেন আপা?’ বললাম। সে একটু চুপ করে থেকে জানতে চাইল, আপা, এমন অবস্থায় আমার কি করা উচিত? না শোনার ভান করে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়া নাকি সরি বলা? বললাম, সরি বা না শোনার ভান কেন? যা সত্যি তাতো সত্যিই।
প্রায়ই শুনি একটা কথা,এই বয়সে এতটা ফিট থাকেন কিভাবে! কেউ কেউ বলেন, এতো বড় বড় ছেলে মেয়ে আছে তা বোঝাই যায় না। আমি প্রশংসা হিসাবেই নেই। দু একবার কি আরও বেশীবার শুনেছি সামনে এবং আড়ালে, স্বামী সংসার নাই, ঝাড়া হাত পা মানুষ, সেইজন্যই বয়স কাবু করতে পারে নাই। সংসার করলে বুঝতে পারতো কত ধানে কত চাল!
এটা কি আমার মতন স্বামী না থাকাদের প্রতি কিঞ্চিত ঈর্ষা নাকি নিজের স্বামীর কারণে ( আসলে কি তাই?) ফিট না থাকার দুঃখ! বুঝতে পারি না। তবে এটুকু বুঝি, যে সমাজে শুধু মাত্র একজন পুরুষের উপস্থিতি বা অনুপুস্থিতিই একজন নারীর ব্যক্তিজীবনের কেন্দ্র চালিকাশক্তি হিসাবে বিবেচিত হয় তখন সেখানে ঘোরতর সমস্যা!