সীনা আক্তার: দেশী-বিদেশী পত্রিকায় প্রায়ই সংবাদ বেরোয় যে জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপে ঢাকা শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কাজের সন্ধানে মানুষ ঢাকায় আসছে, কর্মস্থল ঢাকার বাইরে হলেও অধিকাংশ পেশাজীবি মানুষ তাদের পরিবার ঢাকায় রেখে ঢাকা-কর্মস্থল যাতায়াত করেন। এতে ঢাকা শহরে বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে যেমন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ এর অতিরিক্ত চাহিদা এবং যানবাহন ও বায়ুদূষণের চাপ।
একই অবস্থা অন্য নগরগুলির বেলাও প্রযোজ্য। এসবের মূল কারণ আমাদের দেশে ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা খুব বেশী নগরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে রাজধানীকেন্দ্রিক বা বিকেন্দ্রিকরণের অভাব।
আমাদের দেশে বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আছে, যেমন নগরভিত্তিক সিটি কর্পোরেশন ওপৌরসভা। এর বাইরে আছে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ। কিন্তু আমরা এসব ব্যবস্থার সুফল পাই না, কারণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ সমার্থক নয়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের জন্য সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা সীমিত, প্রায় নাই বলা যায়। এর ফলে নগর এবং মফস্বল-গ্রামের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে তীব্র বৈষম্য লক্ষণীয়।
যেমন, প্রায়ই শোনা যায় অনেক ডাক্তার এবং অন্য পেশাজীবি মফস্বলে তাঁদের কর্মস্থলে থাকেন না। এর যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। একজন কর্মজীবিকে যদি তার কর্মস্থলে নিরাপদ বাসস্থান, পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, স্থানীয় পর্যায়ে যদি তাঁর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকে তিনি কেন ঢাকা-কর্মস্থল দৌড়াদৌড়ি করবেন! একজন শ্রমিকের যদি তাঁর নিজ জেলা বা উপজেলায় কাজের ব্যবস্থা হয় সে কেন ঢাকায় যাবে!
এসব বিবেচনায় আমাদের এখন সত্যিকার ক্ষমতা-সুযোগ-সুবিধার বিকেন্দ্রিকরণ জরুরি। সবগুলো বিভাগীয় শহরকে প্রয়োজনীয় বাজেট এবং লোকবল দিয়ে এর উন্নয়নের পুরো দায়িত্ব তাঁদের দেয়া দরকার, অবশ্যই তাঁদের কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, মানে সেখানে কেন্দ্র থেকে নাক গলানো যাবে না। প্রতি বিভাগ কেন্দ্রের সাথে উন্নয়নের সমন্বয় করবে, যেমনটা ভারতের প্রতি রাজ্যর সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে দেখা যায় । এতে বিভাগগুলির মধ্যে উন্নয়নের একটা প্রতিযোগিতা হতে পারে, কেন্দ্রের উপর চাপ কমবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান তৈরী হবে। বিশেষভাবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সংস্কৃতি থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।
পুরো দেশের পাশাপাশি শহর ভিত্তিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণওএখন সময়ের দাবী। যেমন, ঢাকা শহরের বিকেন্দ্রিকরণ। বর্তমানে ঢাকার প্রশাসন নগর ভবন (উত্তর-দক্ষিণ) এবং সচিবালয় কেন্দ্রিক। এ শহরের আয়তন এবং জনগণ অনুপাতে এর সঠিক বিকেন্দ্রিকরণ দরকার মনে করি। প্রশাসন এবং ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণের মূল সুফল হচ্ছে প্রশাসন কর্তৃক স্থানীয় সমস্যা সঠিকভাবে বুঝতে পারা এবং অধিকতর সেবা প্রদানে সক্ষম হওয়া। এছাড়া জণগণকে উজ্জীবিত রাখা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরী করা, যা দুর্নীতি কমাতে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। পাশাপাশি কেন্দ্রের উপর চাপ এবং নির্ভরশীলতা কমায়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ঢাকায় একটি বা দুটি থানা এলাকা নিয়ে একটা স্থানীয় প্রশাসন/কর্তৃপক্ষ (Local authority) হতে পারে। যেমন লন্ডনে এমন ৩২ টি স্থানীয় প্রশাসন দেখা যায়, যা বারা/কাউন্সিল নামে পরিচিত। আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে ছোট বারা হচ্ছে ‘লন্ডন বারা ইসলিংটন’ (London Borough Islington), আয়তন ৫.৭৪ স্কয়ার মিটার। আবার সবচেয়ে বড় বারা হচ্ছে ‘লন্ডন বারা ব্রোমলী’ (London Borough Bromley), যার আয়তন ৫৭.৯৭ স্কয়ার মিটার। এই বারাগুলিকে সংক্ষেপে কাউন্সিল নামেও ডাকা হয় যেমন ইসলিংটন কাউন্সিল, ব্রোমলী কাউন্সিল। প্রত্যেকটা কাউন্সিল চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রিয় সরকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাজেট পায় এবং স্থানীয়ভাবে সম্পদ আহরণ করে।
যেমন, একজন তাঁর বাড়ির ট্যাক্স দেয় কাউন্সিলকে, কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স দেয় কেন্দ্রীয় সরকারকে। প্রতিটা কাউন্সিল পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং স্থানীয় জনগণের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে। স্বাস্থ্যসেবা, স্কুল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিষয়সহ প্রশাসনিক কোন কাজে এক কাউন্সিলের জনগণকে অন্য কাউন্সিলে বা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যেতে হয় না।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ কখনো কেন্দ্রীয় সরকারকে দুর্বল করে না, বরং অধিক সক্ষম করে। কারণ স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকে এর সম্পদ এবং সুষ্ঠু সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়মিত সেবার মান তদারকি করে এবং স্থানীয় সমস্যার আলোকে উন্নয়নের জন্য নীতিমালা তৈরী করে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মূলত স্থানীয় সমস্যা এবং চাহিদা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন এবং লবি করেন।
সরকার এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা, তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় প্রসাশন শক্তিশালীকরণ এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ জরুরিভাবে আবশ্যক। বলাই বাহুল্য, সুশাসন বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার পূর্বশর্ত।
ড. সীনা আক্তার। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকসের পোস্ট গ্রাজুয়েট, প্যারেন্টিং পেশাজীবি।