সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: ‘মনছবি মিসাইলের মতো লক্ষ্য ভেদ করে’ তবে এই মনছবি দেখতে হয় লক্ষ্যস্থির করে এবং তা বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করতে হয়। পৃথিবীতে যারাই সফল হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখতেন সফলতার। সম্প্রতি ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেটের’ এক গবেষণা নিয়ে রিপোর্ট করেছে ‘প্রথম আলো’।
সেখানে যা লেখা হয়েছে তার অর্থ যাদের লক্ষ্য স্থির তারা যেমন সফল, তেমন তারা দীর্ঘায়ু হয়ে থাকেন। আর যারা যেনতেনভাবে দিন কাটিয়ে দেন, তারা তুলনামুলক কম সময় বেঁচে থাকেন। হেলায় বিত্ত-বৈভবের সুখ হারানোয় আপত্তি নেই আমার, কিন্তু আয়ু? এখানে ঘোর আপত্তি। একটা মূহূর্তও যেন কম না পড়ে বাঁচার। তাই বিষয়টি সত্যিই একবার ভেবে দেখার মতো। অন্ততঃ আমার মতো যারা ‘দিন গেলেই হলো’ ভাবে জীবনযাপন করেন, তাদের তো অবশ্যই ভাবার সময়।
ছোটবেলা থেকে আমার লক্ষ্য নির্ধারণের তেমন কোন সুযোগ ছিল না। স্কুলে যখন আমার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে রচনা লেখার সময় তখন সহপাঠীরা লিখত কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক, এমনকি আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীটি লিখতো, সিনেমার নায়িকা হতে চায় সে।
আমি তখন লিখলাম মাদার তেরেসা হতে চাই। মাদার তেরেসার নোবেল ও ভারতরত্ন পুরস্কার পাওয়ায় তখন ভারতের প্রকাশনায় তাকে নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়েছে। আমার এক আত্মীয় কলকাতা থেকে বেড়াতে আসার সময় কিছু পত্রিকা নিয়ে এসেছিলেন। আমি সেগুলো পড়ে মাদার তেরেসায় প্রভাবিত হই প্রবলভাবে। তখনও আমি প্রাথমিকে পড়ি। আমি অন্যদের মাদার তেরেসার গল্প শোনাই। কিন্তু কেউই তাকে চেনেন না, জানেনও না। তবু আমি মাদার তেরেসার স্বপ্নে বিভোর।
একদিন আমার বাংলার শিক্ষক মান্নান স্যার আমার মাদার তেরেসা হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে রচনা পড়ে বিদ্রুপ করে হাসলেন। বললেন, ‘শোন মাদার তেরেসা, বড় হয়ে তুই ক্রিস্টান হবি? তা কোথায় থাকবি তুই? তোকে তো কোন মিশনারিজে যেতে হবে।’ বন্ধুরাও ঠাট্রা করে মাদার তেরেসা ডাকা শুরু করলো।
কথাটা আমার আব্বার কানে এলো। তিনি ধার্মিক নন, ধর্ম ভীরু মানুষ। বললেন, রাবেয়া বসরি হবি, ফাতেমা, হালিমা হবি কোথায়, বলছিস মাদার তেরেসা হবি! তিনি তো খ্রিস্টান। মহাপাপের কথা আর কখনই যেন উচ্চারিত না হয় আমার মুখে।
১৯৮৪ সাল। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীতে। ভয়াবহ বন্যায় স্কুলের আশেপাশের সমস্ত বাড়িঘর তলিয়ে গেল। স্কুলেও কোমর পানি। নারী-পুরুষ-শিশুরা খড়ের ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছে। পানির তোড়ে সেই ঘর ভেসে যাওয়ায় কোলের শিশু ফেলে দিয়ে মা-বাবা সাঁতরিয়ে ডাঙায় এসে আহাজারী করছে। আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় লোকজন খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজছে। পানি ও খাবারের অভাবে মানুষ মরতে শুরু করছে। খুব কাছে থেকে দেখছিলাম।
সেবারে আমার চাচা আবদুল মজিদ চেয়ারম্যানের কাছে প্রচুর ত্রাণসামগ্রী এলো। কিন্তু বিতরণের কোন সমন্বয় নাই। যে আসছে তাকে দেয়া হচ্ছে, যে আসতে পারছে না, সে না খেয়ে মরছে। আমি একটা নৌকায় স্কুলের কয়েকজন বন্ধু মিলে চেয়ারম্যান চাচার ত্রাণ তহবিল থেকে চিড়া, গুড়, বিস্কুট, ত্রিপাল, ম্যাচ, মোমবাতি নিয়ে দুর্গত মানুষের কাছে গিয়ে দিয়ে আসতে শুরু করলাম। অনেক নারী, বৃদ্ধ, শিশু ও অসুস্থকে নৌকায় করে ডাঙ্গায় তুলে দেয়ার কাজও করতে থাকলাম।
বিপত্তি ঘটলো তৃতীয় দিনে। আমরা ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে নৌকায় ত্রাণ তুলে পশ্চিম ধনিরামের দিকে যাচ্ছি। পানিতে পুরো জনপদ তলিয়ে কুল কিনারহীন সমুদ্রের মতো ভাসছে। সাথে প্রবল স্রোত। আমাদের নৌকা ধনিরাম পৌঁছার আগে প্রবল স্রোতে পড়ে তলিয়ে গেল। আমরা আটজন বন্ধু ও নৌকার মাঝি প্রায় ২শত গজ দুরে উপড়ে যাওয়া গাছের সাথে আটকা পরে আধমরা অবস্থায় ভাসতে পারলাম। দুর্গতদের আহাজারী লোকালয়ে না পৌঁছালেও, আমাদের ডুবতে যাওয়ার খবর বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেল। প্রায় সবার অভিভাবক চলে এল কান ধরে বাড়িতে নেয়ার জন্য।
আমাকে বাড়িতে নিয়ে মাদার তেরেসা বলে গালি(!) দিতে দিতে পিটুনি দিয়ে ঘরে আটকে রাখা হল। সেই বন্যার পানি নামার এক মাস পরেই আমার দস্যিপনার অপরাধে জোর করে বিয়ে দেয়া হল। বেঁধে দেয়া হল বন্দিত্ব জীবন। আমার আর কখনও জীবনের লক্ষ্য নিয়ে রচনা লেখা হলো না। হলো না কোন লক্ষ্য স্থির করাও।
তারপর যা হলো, তা কোন লক্ষ্য থেকে নয়। ‘যা হবার তাই হবে’ এমন লক্ষ্য নিয়েই আমি সব বাধা অতিক্রম করে পড়ালেখাটা শেষ করলাম। সাংবাদিকতা শুরু করলাম। এই বাধা অতিক্রমের অপরাধে আমার অনেক কিছুই হল। আমি ঘরছাড়া হলাম। হলাম পরিবার বিচ্ছিন্ন। শুধু ছেলেমেয়ে দুটোর দায়-দায়িত্ব ছাড়া কিছুই বাকী রইল না। কিন্তু জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়নি কখনও। বরং বেড়েই চলছে। যেনতেন ভাবে দিন পার করার ব্রত নিয়ে জীবনকে হালকা ভাবে দেখে এতটা পথ অতিক্রম করলাম। এভাবেই কেটে যাবে যতদিন বাঁচি।
তবে এটাই কি আমার লক্ষ্য স্থির হয়েছে? এটাই কি আমার মনছবি? না, আমি মনছবি দেখি না। লক্ষ্য স্থির করে আত্মনিয়োগও করি না। তাই আমার মাদার তেরেসা হওয়া হয়নি। তবে আমি কল্পনায় কখনও নিজের ভবিষ্যতে চলে যাই। স্পষ্ট করেই দেখি। বার বার একই দৃশ্যে নিজেকে দেখি। পাশাপাশি কয়েকটি দোতলা বাড়ির সামনে সুন্দর পরিপাটি জনশূন্য একটি রাস্তা। আমি হেঁটে বেড়াচ্ছি পাশ্চাত্যের পোশাকে কোন এক বিকেলে। নিজেকে প্রৌঢ়া, কিন্তু সুঠাম ও সুস্থ মনে হয়। নীরব নিঃসঙ্গতার মাঝেও কোন অতৃপ্তি নেই আমার, নেই কোন আকাঙ্খাও।
হয়তো এটাই আমার পরপারের জীবন। যেনতেন ভাবে যেন কেটে যায় সেটাও।
সালেহা ইয়াসমীন লাইলী
সাংবাদিক ও লেখক