মাহফুজা জেসমিন: যদি আঁধার রাতে ঝড়-বাদলে আলো না ধরে…তবে বুকের মাণিক জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে’ রবীন্দ্রনাথের এই গানের সাথে একা চলার বেদনার চেয়েও একাকার হয়ে আছে একা চলার অনুপ্রেরণা।
নিয়ম অনুযায়ী মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘মা’ দিবস। যে তাঁর শরীরের সম্মিলিত শক্তির নির্যাসটুকু দিয়ে সন্তানকে ধারণ করেন, লালন ও পালন করেন তাঁর প্রতি আলাদা করে সম্মান জানানোর দিন। এই দিনকে ঘিরে আমরা নানা আয়োজন করি।
প্রণমি তোমারে মা। কিন্তু যে মা কেবল একটি সন্তানের জন্য জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়েছেন..নিজের দিকে ফিরে তাকাননি, কিংবা একটি সন্তান লালন পালনের জন্য একাকি নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছেন তাঁদের জন্য আজ আমার সকল ভালোবাসা—
“মা, তুমি আমাদের ছেড়ে যেওনা। আমরা তোমার কাছে কিছুই চাইনা। তুমি শুধু আমাদের কাছে থাকো”- স্মৃতি আর প্রীতি’র এই আকুলতা আর্তি’র ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দেয়। বাড়ি ছেড়ে চাকুরিতে যাওয়া হয়না।
তিন বছর এবং সাত বছর বয়সের দুই মেয়েকে নিয়ে তার একা চলার সংগ্রাম শুরু হয়েছে দু’বছরেরও বেশি সময়। মা-বাবার বাড়িতে বাচ্চা দু’টিকে নিয়ে ঠাঁই হলেও বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর্তি ঢাকা যেতে চায়। চাকুরি করবে। মায়ের কাছে বাচ্চাদের রেখে পড়ালেখা করাবে বলে। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায়। পড়ালেখা আর হয়ে ওঠেনি। ভালোবাসার বিয়ে। দুই সন্তানের জন্মের পর স্বামী চলে যায় শহরে। জীবিকার তাগিদে। কিন্তু তারপর বদলে যায় মানুষটি। সে এখন অন্য কারো। তার এখন অন্য পথ। কিন্তু আর্তির সামনে অন্তহীন অনিশ্চয়তা। নিজের কথা বাদ দিলেও দুই সন্তানের ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে ভেবে কিনারা করতে পারে না। নতুন করে ভাবে। গ্রামেই থাকবে। নিজের হাতে সেলাই করেই জীবিকা নির্বাহ করবে। আরেকটু পড়ালেখা করবে সে….. নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আর্তি উপজেলা সদরে যায়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে আর্তি এগিয়ে যাচ্ছে সন্তানের মঙ্গল কামনায়। সন্তানের ভবিষ্যত ভেবে নতুন স্বপ্ন নিয়ে তার এই পথচলা….সফল হও মা। তোমাকে শত প্রণাম।
কপর্দকশূণ্য, দু:শ্চরিত্র স্বামীর সংসারে এসেও নিজেকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা কখনো ভাবেনি রানু। স্বামীকে সংশোধন করার জন্য নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে শহরে। স্বামীকে সহায়তা করতে চেয়েছে। সংশোধন করতে চেয়েছে। ভালো সঙ্গ পেলে স্বামী বদলে যাবে এমন ভাবনা থেকেই ১২ বছর স্বামীর সংসার করে সে। বিয়ের দু’ বছর পরই কন্যা সন্তানের জন্ম দেয। সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় তার নতুন সংগ্রাম। গৃহপরিচারিকার কাজ করে, হাতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করে। কিন্তু স্বামী বদলায় না। কয়েকদিন পরপরই চুরি করে ধরা পরে আর হাজত বাস তার অনিবার্য নিয়তি। অথবা নিখোঁজ হয়ে যায়। স্বামীর সন্ধান না পেয়ে পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে অমৃতাকে নিয়ে ফিরে আসে নিজ গ্রামে। দরিদ্র মা বাবা আর তিন ভাইয়ের সংসারে অযাচিত, অবাঞ্ঝিত রানু । তার সাথে আবার মেয়ে। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। এ ঠাঁই ও ঠাঁই করে। নিজের জায়গা হয়তো… মেয়ের জায়গা হয়না! মেয়ের জায়গা হয়তো…নিজের জায়গা হয়না!
রানু ঢাকায় আসে। রানু আত্মীয়-পরিজনের সহায়তায় চাকুরি পায় সিটি হাসপাতালের আয়া হিসেবে। মেয়েকে নিয়ে আসে। কিন্তু সেখানে এসে ও শান্তি হয়না। স্বামী এবার খুঁজে খুঁজে ঢাকায় আসে। শুরু হয় নির্যাতন। ঘরে শুয়ে বসে খাবার খায়। আর রানুর ওপর নানান অত্যাচার চালায়। এ অবস্থায়ই রানুর গর্ভে আবার আসে সন্তান। পাঁচমাসের গর্ভকালীন অবস্থায় রানুকে মেরে অজ্ঞান করে রেখে পালিয়ে যায় স্বামী। সহকর্মীদের সহযোগীতায় দীর্ঘ একমাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে রানু ফিরে পায় নতুন জীবন। এবার স্বামীকে তালাক দেয় সে। স্বামীর নানান হুমকির মধ্যেও অনড় থাকে সিদ্ধান্তে। রানুর আর চাকুরি করা হয়না। মেয়েকে আত্মীয়ের বাসায় রেখে পড়ালেখার সংস্থান করে। জীবনে একটি দিনের জন্যও স্কুলে পড়তে যেতে না পারা রানু বোঝে সামান্য পড়ালেখা জানলেও তার জীবন আজ অন্যরকম হতো। রানু এখন ভাঙা স্বপ্নের জোড়া দিতে দিতে আরেক আত্মীয়ের বাসায় আত্মীয়ের বাচ্চার দেখা শোনা করে। নিজের সন্তানকে একদিনের জন্যও নিজের ইচ্ছেমতো যতœ না করতে পারা রানু বিষাদে আক্রান্ত হয়। নি:শব্দ কান্নায় একাকার হয়। তবুও দায়িত্বে অবহেলা করেনা কখনো। পৃথিবীর সব শিশুর মধ্যেই সে দেখে নিজের সন্তানের মুখ। সবার জন্যই তার অপার ভালোবাসা। তোমার ভালোবাসা অক্ষয় হোক মা। সার্থক হোক তোমার একা চলার সংগ্রাম।
জীবন জুড়েই একাকিত্ব অপরাজিতার। ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে ২৩ বছরই একা। এক পুত্র সন্তানের মা হওয়ার পরই স্বামী চলে যায় অন্যত্র। বিয়ে করে আরেকজনকে। অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত স্বামী স্ত্রী বা সন্তানের খবর না নিলেও অপরাজিতা একাই টিকে থাকার সংগ্রাম করে। নাচ, গান, আবৃত্তি, খেলাধুলা, রান্নায় পারদর্শী যে মেয়ে সেই জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়ে প্রথমে সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করে। পরে এসএসসি, এইচএসসি এবং বিএ পাশ করে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ পায়। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে মা-বাবা ও দুইভাইয়ের সংসারে সে নিজেই হয়ে ওঠে সকলের আশ্রয় স্থল।
নিজের দিকে ফিরে তাকায়নি অপরাজিতা। বাবার বাড়ি ফিরে আসার কয়েক বছর পরই বাবা অসুস্থ হয়ে পরেন। ইতিমধ্যে বাবা মারা গেছেন। ছোট দুই ভাইকে মানুষ করে তাদের বিয়ে ও দিয়েছেন। একমাত্র সন্তান এরফান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে। কিন্তু অপরাজিতা একা পড়ে আছে কক্সবাজারে। এখন তার সাথে পরিবারের মানুষের সম্পর্ক কেবল টাকার। হাতে টাকা ফুরিয়ে গেলে অপরাজিতা ঢাকায় আসে না। টাকা ছাড়া ঢাকায় আসলে চলবে কি করে…..! জীবনের পুরোটা সময় যার একা কেটে গেলো তার সামনে কেবলই অন্ধকার। তবুও প্রতিমুহূর্তে মনের আলো জ্বেলে অপেক্ষা করে আরেকটি উজ্জ্বল দিনে আশায়…যেদিন তার ছেলেটি সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে! তোমার এই একলা চলা সফল হোক মা।
ঢাকা শহরের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সামনে খুব সুখী সুখী চেহারার মানুষ। বেশির ভাগই গাড়িতে করে আসা যাওয়া করে। তারই মধ্যে একদিন চোখ আটকে যায় একটি স্কুটি দেখে। মা স্কুটি নিয়ে মেয়েকে স্কুলে দিতে এসেছেন। কাজ করেন বেসরকারি সংস্থায়। কাছাকাছিই অফিস। স্কুল ছুটি হলে বাচ্চাকে নিয়ে যাবেন আবার। বাচ্চার বাবা কোনদিনই আসেন না। জানতে পারি, তিনি থাকেন অন্য কারো সাথে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনে আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে আরেক মা অপেক্ষা করে মেয়ের হলে ফেরার। বিশ্ববিদ্যলয় হলে আজ মেয়ের শেষ দিন। আজ নিজেকে আরো বেশি একা লাগছে। ২২ বছর পার করে দিয়েছেন সুলেখা। মেয়ে সুরশ্রীর তিন বছর বয়সে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান অধ্যাপক স্বামী। নিজেও একটি কলেজে পড়াতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সুরশ্রীকে নিয়ে শুরু হয় তার একা চলার সংগ্রাম। আর ক’দিন বাদেই সুরশ্রীর বিয়ে। দু’মাসের মধ্যেই স্বামীর সাথে পাড়ি জমাবে আমেরিকায়। সুলেখা’র ভেতরে ২২ বছরের জমাট বাঁধা কান্না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বোশেখের ধুলোঝড়ে ভেসে যায় তার বেদনার অশ্র“। তুমি একা নও মা। তোমার পাশে আছে হাজারো…লাখো …একা মা। তাদের অনুপ্রেরণা তুমি।
মাহফুজা জেসমিন, সাংবাদিক