মাহফুজা জেসমিন: সারা বিশ্বে নারীর প্রথম জাগরণ ঘটেছিলো ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। একজন নাগরিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নারীর প্রথম অগ্রযাত্রা। ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য জন স্টুয়ার্ট মিল প্রথম নারীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন। তারও প্রায় দু’দশক পরে নিউজিল্যান্ড সর্ব প্রথম নারীদের ভোট দেয়ার অধিকার দেয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৯৩৫ সালে প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করেন। ভারত বিভাগের পর অবিভক্ত পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের নারীরা ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পান।
ভোটাধিকার আন্দোলনের ২১ বছর পর ১৯১০ সালে শুরু হয় কর্মজীবী নারীর ন্যায্য পাওনা আদায়ের সংগ্রাম। সে বছর ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কর্মদিবস, ন্যায্য মজুরী ও কল-কারখানায় কাজের পরিবেশের উন্নতির জন্য রাস্তায় নেমে মিছিল করেন। ওই মিছিলে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
আজ সারা বিশ্বে রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধান, পার্লামেন্টারিয়ান, কুটনীতিক এবং তৃণমূলের নেতৃত্বে ও নারীর শেকড় প্রথিত। শুধু তাই নয়, নারী আজ জয় করছে পর্বতের চূড়া অবধি। আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তো নারীর জয় জয়কার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদগুলো অলংকৃত করছেন নারীরা। তা সত্বেও এক দশকের বেশি সময় ধরে সংসদে নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন ও আসন সংখ্যা ৩৫ শতাংশ করার দাবি আজ অব্দি পূরণ হয়নি। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীসহ দেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা সেদেশে নারীর উত্থান অবশ্যম্ভাবী। জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা এবং সংসদ উপনেতাও নারী। দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতাও নারী। মন্ত্রী পদেও আছেন নারীরা।
তবুও কি আপামর নারীর দিন বদলেছে ? যখন এদেশেই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে উচ্চ শিক্ষার মাশুল দিতে হয় নিজের দুচোখের বিনিময়ে, কেবল পড়ালেখা করতে চাওয়ার অপরাধে হারাতে হয় হাতের আঙুল, আর প্রতিদিন অজস্র নারীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয় ঘর থেকে বের হওয়ার অপরাধে। আর যারা ঘরেই থাকেন, জীবনের বেশির ভাগ সময় যারা ঘরেই কাটিয়ে দিলেন তারাই বা কতটা ভালো আছেন। নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে যতনা নারীকে লাঞ্ছিত হতে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি নারীকে লাঞ্ছিত হতে হয়, কেবল তার নির্ভরশীলতার জন্য, অসহায়ত্বের জন্য। যৌতুক দিতে না পারার জন্য, সন্তান জন্ম দিতে না পারার অপরাধে, কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে, ভালোবাসার অপরাধে এবং ভালো না বাসার অপরাধে।
আজ নারীকে নির্যাতিত হতে হয় ভোট দেয়ার অপরাধেও। যেখান থেকে নারীর দিন বদলের সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো, শতবছরে চিত্রটি পাল্টে সেখানেই আবার থমকে গেছে। অর্থ্যাৎ দিন বদলেছে। বদলেছে সমাজও। কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি। সারা পৃথিবীতে কবি সাহিত্যিকরা একদিকে নারীর স্তুতি করেছেন অসাধারণ উপমায়। অন্যদিকে নারীর নিন্দা করেছেন অশালীন বাক্যবাণে। নারী এখনও প্রতিশোধ গ্রহণের হাতিয়ার। আগের দিনেও যুদ্ধের অন্যতম কৌশল ছিলো নারীর প্রতি সহিংসতা, এখনও তাই। পাশের বাড়ির সাথে সীমানা বিরোধ, প্রতিশোধের লক্ষ্য নারী। সামাজিক বিরোধেও হাতিয়ার নারী। আজো নারীরা ব্যবহৃত হচ্ছেন।
একজন সরকার প্রধান কিংবা দলীয় প্রধান যখন নারী তখনও তাকে একজন মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে বাধে। একজন নারীকে ‘নারী’ হিসেবে ঘায়েল করার জন্য যত ‘অশ্রাব্য’ অশ্লীল ব্যবহার করা যায়, মানুষ’কে তো ততটা নয়। একজন নারী মন্ত্রী হলে, সংসদ সদস্য হলে তার উত্থান কিংবা পতনকে দেখা হয় ‘আদিমতম মানবিক’ সম্পর্কের মাপকাঠিতে। তার দক্ষতা ও যোগ্যতার মূল্যায়ণটি হয় পরে। আর যখন এই দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ হয়ে যায়, একদল চুপ মেরে যান। অন্য দল ভাবেন, ‘ওরকম সুযোগ পেলে আমিও দেখিয়ে দিতাম’।
নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির এই সংকটটি কেবল ব্যক্তি মানসের নয়। সমাজেরও। রাষ্ট্র ও সমাজ যখন নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তখন নারীর অসহায়ত্ব প্রবল হয়ে ওঠে। সময়ের বিবর্তনে, শিক্ষার প্রসারে সমাজের একাংশের নারীর অগ্রযাত্রা হলেও বড় অংশের নারীরা এখনও অনেক পেছনে পরে আছেন। সংসারের সাতপাক সেরে যদিওবা তারা বেরিয়ে আসতে চাইছেন তখনই সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে থমকে যাচ্ছেন সদর দরজার চৌকাঠে।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন বাড়ছে, বলা হচ্ছে ‘অর্থনীতির চাকায় তৃণমূলের নারীরা সম্পৃক্ত না হলে এ প্রবৃদ্ধি অর্জন হতো না’। কিন্তু এই লাখ লাখ নারী যারা উন্নয়নের চাকা ঘোরাচ্ছেন তাদের একান্ত নিজের চাকাটি কেমন করে ঘুরছে সেটি বিবেচনায় না আনলে সমাজের গভীরের মৌলিক পরিবর্তনটি সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, নারীর সত্যিকারের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিটি ব্যক্তিকে সম্মানিত করতে পারলেই কেবল গোষ্ঠীকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এসে বাংলাদেশের তৃণমূলের রাজনীতিতে যুক্ত হন নারীরা। অন্তু:পুরের সীমানা পেরিয়ে, চৌকাঠ পেরিয়ে নারী নেমে আসেন গণ মানুষের কাছে। গণমানুষও তাদের সেই মর্যাদা দিতে পিছপা হননি। গণমানুষের ভোটেই তারা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়ে আসেন। কিন্তু তাদের এই নির্বাচিত হয়ে আসাটা প্রথমত বাধা মনে হলেও সেটি অতিক্রম করে এসে তারা প্রথম মুখোমুখি হন নারী সত্বার সাথে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দের। ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নিয়েই প্রথম সংঘাত বাধে তাদের সহকর্মী অন্যান্য নির্বাচিত পুরুষ সদস্য ও চেয়ারম্যানের সাথে। গত দুই দশক ধরে এই দ্বন্দ সংঘাতের ফলাফল হিসেবে হত্যা, সংঘাত তো বটেই, ধর্ষনের শিকার ও হতে হয়েছে নির্বাচিত নারী সদস্যকে।
সাম্প্রতিক সময়ে নারীকে অনেক বেশি শক্তিশালী মনে হয় গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে। গণমাধ্যমের সকল শাখায় এখন নারীর অবাধ বিচরণ। নাটক, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্রে নারীর সৌন্দর্য্য ও অভিনয় শৈলীর যে প্রকাশ হতো তার পরিসর বেড়েছে। নারীর কাজের ক্ষেত্রও বেড়েছে। নারীরা এখন নাটক, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেরা নির্মাণ করছেন চলচ্চিত্র। বিজ্ঞাপন চিত্র। নাটকও প্রযোজনা করছেন। তারা রাত জেগে নিউজ এডিট করছেন, সংবাদ সংগ্রহ করতে ছুটে যাচ্ছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন কেউ কেউ। হাতে তুলে নিচ্ছেন ক্যামেরা। কিন্তু এই ছুটে চলা নারীর সংগ্রাম কি কেবল ছুটে চলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? নাকি তার সংগ্রাম প্রথিত ছুটে চলার অন্তরালে। সীমিত সংখ্যক নাটক, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা ছাড়া অন্যান্য গণমাধ্যমের নারীরা গণমাধ্যমে স্থান পান ‘গণমাধ্যম কর্মী’ হিসেবে। কোন উচ্চ পদে তাদের জায়গা হয় না। সারাবিশ্বে ‘গণমাধ্যম’ সবচেয়ে ঔদার্য্যরে জায়গা হিসেবে পরিচিত হলেও ভেতরের রূপটি ভিন্ন। গণমাধ্যম ‘ঔদার্য্যরে বাণী’ প্রচার করে। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেই সত্যিকারের ঔদার্যের পরিচয় বিরল।
গণমাধ্যমকে সবাক নারীর উপযুক্ত স্থান হিসেবে দেখা হলেও ক্ষমতায়নের দিক থেকে গণমাধ্যমের নারীরাই সবচেয়ে পেছনে। গণমাধ্যমের নারীরা কাজ করছেন সবধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে। নারীরা কাজ করেন মাঠে-ঘাটে, অফিসে। তারা দিনে-রাতে সমানভাবে দায়িত্ব পালন করেন। চাকুরির অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তা হীনতার মতো চ্যালেঞ্জগুলোও নারীর জন্য বেশি চাপ। চাকুরির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন পুরুষ যে নিরাপত্তাহীনতায় পরে সেটি জীবন সংশয়ের চেয়ে বড় নয়। কিন্তু সমাজের পদে পদে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি সে কারণে নারীর নিরাপত্তা হানী ঘটে নানা ভাবে। জীবন সংশয়ের আশংকার পাশাপাশি তার থাকে লাঞ্ছনার ভয়। অপমানের ভয়। এই ভয় তার জীবন সংশয়ের চেয়েও বেশি। চাকুরির অনিশ্চয়তাটা নারী পুরুষ সবারই আছে। তবুও নারীদের জন্য গণমাধ্যমে চাকুরি পাওয়া বা হারানোর পেছনে কার কতটুকু ক্রোধ সেটাই উঠে আসে বারবার।
গত এক দশকের উন্নয়ন পরিসংখ্যানগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সর্বত্রই নারীর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ শুধু নয়, তাদের অবদানও রয়েছে। বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও গণমাধ্যমের অগ্রযাত্রায় নারীর পথচলাটা লক্ষনীয়। কিন্তু তার স্বীকৃতি হিসেবে উচ্চ পদগুলোতে নারীর অবস্থান আজো সুদৃঢ় হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর যে প্রতিষ্ঠা তা অর্জন হয়েছে নারীর দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মমর্যাদার লড়াই, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নে তৃণমূলের নারীর যে অগ্রযাত্রা তার স্বীকৃতির জায়গাটা দেখার সৌভাগ্য আজো আমাদের হয়নি। ব্যাংক, বীমাসহ সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদে নারী নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। আর এটিই সম্ভবত আমাদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে সবলতর ও দুর্বলতর দিক। সবলতর কেন এর অনেক উত্তর আছে। তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণটি হলো রাষ্ট্রের যেকোন সংকটে শেষপর্যন্ত আপামর জনসাধারণের ইচ্ছায়ই সমাধান হয়। একাত্তরের পর সেটি আমরা নতুন করে দেখেছি ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে গণজাগরনের মধ্যে দিয়ে। এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। দুর্বলতার জায়গাটি হলো আইন, নীতিমালা বিধান বাস্তবায়ন না হওয়া। জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষার জন্য সরকার অনেক আইন, নীতিমালা, বিধান দেন। কিন্তু তার সঠিক বাস্তবায়ন হয় না। তা নিয়ে কিছুদিন আলোচনা-সমালোচনা হয়। তারপর সেই পদক্ষেপগুলো জাতীয় জীবনে কতটা কার্যকর হলো সেটি আর খুঁজে দেখা হয়না। নিজ নিজ জায়গা থেকে বাস্তবায়নের উদ্যোগও খুব সীমিত।
সারাবিশ্বে নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই সুদৃঢ়তর হয়েছে। নারীর সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও এসেছে। বাংলাদেশে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রণীত হয়েছে। আইন, বিধি-বিধান হয়েছে। তার প্রয়োগ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হয়েছে তা আমরা বুঝতে পারি যখন দেখি নারী নির্যাতনের সংখ্যাটিই শুধু বাড়ে নি। এর সাথে যোগ হয়েছে নতুন ধরনের সহিংসতা। অর্থাৎ নারীর জন্য আইন হলেও সে আইন আপামর মানুষ জানেনা।
নারীর কর্মক্ষেত্রের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম নারীর যৌন হয়রানি। নারীর কর্মপরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় কখনো কখনো এটি পুরুষেরও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের ভাষায় ‘জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মপরিবেশ’ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান জরুরী। মানবাধিকার কর্মী এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মপরিবেশ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছ থেকে সর্বোত্তম উৎপাদন ও সেবা নিশ্চিত করে।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমে সংঘটিত বিভিন্ন যৌন হয়রানির ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রান্তিক নারীদের আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি’র নির্বাহি পরিচালক সালমা আলী বাদি হয়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কেন রাষ্ট্রীয় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে না এই মর্মে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা (রীট পিটিশন নং ৫৯১৬/২০০৮) দায়ের করেন। এই মামলায় উল্লেখিত ভিকটিম, গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে মহামান্য আদালত ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রায় ঘোষণা করেন। উল্লেখিত রায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সকল প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে “যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠনের আদেশ দেয়া হয়। এই আদেশে কোন কোন আচরণকে যৌন হয়রানি বলা যাবে, এর প্রতিকার, কমিটির দায়িত্ব এবং কমিটি গঠন সম্বলিত রায় প্রদান করা হয়।
সালমা আলী জানান, সুপ্রীম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিভাগ, অধিদপ্তর ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ সংক্রান্ত আদেশ পাঠানো হলেও আজো পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাড়া মেলেনি। তিনি বলেন, আমরা মামলা করে একটি রায় পেয়েছি। মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের রায়কে বাস্তবায়ন করা সকলের নাগরিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
সালমা আলীর মতে, জেন্ডার সংবেদন কর্মপরিবেশ নারী-পুরুষ উভয়ের মর্যাদা সুরক্ষা করে। প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, আমরা মনে করিনা যে পুরুষরা কখনো যৌন হয়রানির শিকার হন না। তাই পুরুষরাও যদি কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন তারা সম বিচার পাবেন। তবে এখানে নারীর কথা বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে এজন্য যে পুরুষরা সমাজে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু নারীর জন্য সমাজটা এখনও তৈরি হয়নি। তবে মহামান্য আদালতের রায়ে কর্মক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে যৌন হয়রানি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে সে বিষয়ে সকলকে ধারনা দেয়াটাও জরুরী।
ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস এ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগের পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, জেন্ডার পলিসি হলো একটি টুল। যা একটি অর্গানাইজেশনের কর্মীদের কাছ থেকে সর্বোত্তম সার্ভিস পাবার মেকানিজম। এটি নারী পুরুষ সবার মধ্যে মান সম্পন্ন আচরণ শেখায়। একজন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি মনে করেন, জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মপরিবেশ বজায় থাকলে এটি যে কোন সংস্থাকে একটি মানসম্মত অবস্থায় পৌঁছায়। তাই এটি বাংলাদেশের উন্নয়নেরও মূলমন্ত্র।
২০১০ সালের ৮ এপ্রিল ও ২৯ এপ্রিলে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো পৃথক চিঠিতে দেখা যায়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের উপরে উল্লেখিত এক রায়ের প্রেক্ষিতে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মপরিবেশ বজায় রাখতে এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমপক্ষে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘কমপ্লেইন কমিটি’ গঠন করার কথা। সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে এধরনের কমিটি থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এর বাস্তবায়ন খুবই কম।
এমনকি সব বিষয়ে সংবেদনশীল, সরকারী-বেসরকারী সকল কর্মকান্ডের মানদন্ড নির্ধারণকারী গনমাধ্যমেও এর প্রতিফলন ঘটেনি। দু’একটি খবরের কাগজ ছাড়া কোথাও এই কমিটি হয়নি। গণমাধ্যমের কর্মীদের হয়রানি করার জন্য যত ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমন করা হয় তা বোধ করি অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে নেই। আর এই ‘যৌন নিপিড়ন প্রতিরোধ কমিটি’ করার বিষয়টি সামনে আসলেই সবাই ধরে নেন নারীর মর্যাদাকে অধিকতর সুরক্ষার জন্য এটি করতে চাওয়া হচ্ছে। এমনকি এটি পুরুষকে দমন করার জন্য করা হতে পারে বলেও অনেকে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু অফিস-আদালতে সুস্থ কর্মপরিবেশ মানে যে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই এটি সুরক্ষা সেটি তারা বুঝতেও চান না।
সরকার কেবল জেন্ডার পলিসি করেই বসে থাকেনি। গত দুই বছর আমরা জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটও পেয়েছি। আবার প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে জেন্ডার সংবেদনশীল নীতি তৈরির জন্য নিয়মিত পত্রে তাগিদ দেয়াও অব্যাহত রয়েছে।
একজন মানুষ হিসেবে তো বটেই, একজন নারী এবং একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে চারপাশের দেখার জগৎটা আলাদা নয়। সামাজিক মূল্যায়ন ও অবমূল্যায়নের অভিজ্ঞতা সবার কম বেশি একই রকম। তবুও গণমাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়েরই দুর্বলতার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে তার একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন। যখনই কাউকে প্রতিহত করার বা ঘায়েল করার বিষয় আসে সেটির লক্ষ্য হয়ে ওঠে একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। যার সাথে হয়তো তার কর্মস্থলের কোন সম্পর্কই নেই। সত্য কিংবা মিথ্যা সেটা যাচাই না করেই মানুষ তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। কখনো কখনো এটা এতটাই প্রবল আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে যে সেটি পরিবার পর্যন্ত গড়ায়। এবং একারণে পারিবারিক সম্পর্কেও ফাটল ধরে। এই সংকট কেবল গণমাধ্যমের নারী কর্মীদের জন্য নয়। পুরুষ কর্মীদেরও। তবে পার্থক্য হলো এই যে পুরুষ ’দের পক্ষে এ সংকট হয়তো সাময়িক। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এই সংকট তার পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে।
রাজনীতিতে ব্যক্তিগত কটাক্ষ করে কথা বলাটা এখন অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিক সংগঠনের বিভিন্ন কর্মকান্ডে অপপ্রচার প্রবল হয়ে উঠেছে। সে কারো পদোন্নতিকে কটাক্ষ করতেই হোক। আর সংগঠনের নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবেই হোক। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর কল্যাণে অপপ্রচারের অংশ হিসেবে ইমেইল এবং লিফলেট ব্যবহার করা হয়েছে। অকথ্য বাংলা ব্যবহার করে কারো বিরুদ্ধে লিফলেট লিখে পত্রিকা অফিসে বিলি করার মতো ঘটনাও গণমাধ্যমের কর্মীরাই করছেন।
আর এই কাজগুলো যারা করেন বা করছেন তারা সংখ্যায় খুব কম। তাদের পেশাগত দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এসব কাজে তারা সিদ্ধহস্ত। কারণ অন্যের ক্ষতি করার মধ্যে দিয়ে তারা নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার কৌশলটি ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এসব কাজ করার জন্য কোথাও তাদের জবাবদিহি করতে হয়না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো জায়গাও প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই।
এখন কথা হচ্ছে এসব সমস্যা কি আসলে অনেক বড় সমস্যা?। যখন মানুষ সমাজে, রাষ্ট্রে এবং কর্মক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে মর্যাদা পায়না, তখন তার ভেতরে যে হতাশা ও ক্রোধ জন্ম নেয়, তাতে তার দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্থ হয়। আর এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সমাজ ও রাষ্ট্র। আর একারণেই এটি অনেক বড় সমস্যা। শুধু নারীর জন্য নয়। পুরুষের জন্যও। ভালো কাজের জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ও পরিবেশ। সুস্থ কর্মপরিবেশ না থাকলে কারো পক্ষেই সৃজনশীল কাজ করা সম্ভব নয়।
সত্যিকার অর্থেই জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির সুফল নিশ্চিত করতে চাইলে ‘জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মপরিবেশ’ জরুরী। সেটি মাথায় রেখেই মহামান্য হাইকোর্ট উপরে উল্লেখিত রায়টি দিয়েছেন। ‘জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মপরিবেশ’ তৈরির লক্ষ্যে প্রত্যেক গণমাধ্যমে রায়টি’র প্রতিফলন হলে নারী-পুরুষ উভয়েরই সুরক্ষা হবে। তাছাড়া বিচার বিভাগ, দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং বাস্তবায়ন করাটাও প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই দায়িত্ব।
(লেখাটি রিপোর্টার্স ইউনিটি থেকে প্রকাশিত কণ্ঠস্বর থেকে নেয়া)