
লীনা হক: বৈশাখের এই প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে কাজের চাপও একটু বেশি। গত সপ্তাহে এত মিটিং ছিল যে সকাল ৮ টার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হতে হতো। সাহেরার সাথে শুধু দরকারি কথা ছাড়া আর তেমন কোন কথা বার্তা হচ্ছিলো না। আগামী সপ্তাহে আবার ঢাকার বাইরে যেতে হবে। এদিকে নেপাল থেকে সহকর্মী এসেছে, আমার বন্ধুও বটে, তাকে শুক্রবারে খেতে বলেছিলাম বাসায়। সব মিলিয়ে সময়ের বেশ টানাটানিই গেল বলতে গেলে গত দিন দশেক। আজকে বিকেলে একটু অবসর পাওয়া গেল। আগামী সপ্তাহে বাসার বাইরে থাকবো বলে সাহেরার সাথে একটু কাজের আলাপ করার জন্য ডাকলাম, সাহেরা এসে বসলো খাটের পাশে।
তার মলিন মুখ দেখে জানতে চাইলাম কি হয়েছে। শরীর ভাল আছে কিনা। মেয়েরা ভাল আছে কিনা, নাকি স্বামীর সাথে আবার কিছু ঝামেলা হয়েছে! ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে সাহেরা। কি হয়েছে, কেন কাঁদছে স্নেহভরে জানতে চাই, এতে সাহেরার কান্না আরও বেশী হয়ে উঠলো। একটু বিহবল বোধ করি, কান্না থামাতে কি করবো বুঝতে পারি না। এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল এনে দেই সাহেরাকে। এক চুমুকে গ্লাস খালি করে ফেলে সে। একটু স্থির হয়। জানা যায় ঘটনাটা।
সাহেরা আমার বাসা ছাড়াও আর একটি বাসায় কাজ করতো, দুই বাসা থেকে মোট সাড়ে সাত হাজার টাকা পেত। করাইল বস্তিতে যে ঘরে তারা থাকে, ঘর ভাড়া,গ্যাস,পানি, বিদ্যুৎ মিলে ভাড়া ২৫০০ টাকা মাসে। ছোট মেয়ের লেখা পড়ার খরচ সাহেরা দেয়, আর বাড়িতে বড় মেয়ের জন্য পাঠায় ১০০০ টাকা মাসে মাসে। আমি একটি পোস্ট অফিসে একাউন্ট খুলে দিয়েছি সেখানে সে কিছু জমায়। এই জমানোর বিষয়টি বাউন্ডুলে স্বামীর কাছে থেকে গোপন রাখে সাহেরা। আর স্বামী কোনদিন ১০০ টাকা কোনদিন ৭০ কি ৫০ টাকা দেয় চাল, ডাল, তরিতরকারি কেনার জন্য। মাসের মধ্যে ১০/১২ দিন কোন টাকাই দেয় না, কারণ রিকশাচালক স্বামী রিকশা চালানোর চাইতে জুয়া খেলতে বেশী পারঙ্গম।
এই ভাবে চলছিল সাহেরার সংসার। গত জানুয়ারি মাসে সাহেরার ডান হাতে প্রচণ্ড মাসল পুল হওয়াতে ডাক্তার ভারী কাজ করতে নিষেধ করেছেন। অন্য বাসাটিতে ভারী কাজের পরিমাণ বেশি। সেজন্যও সেই কাজটি সাহেরাকে ছাড়তে হয়েছে গত দুই মাস হয়ে গেছে প্রায়। এর মধ্যে সে আরেকটি বাসায় কাজ নিয়েছিল, কিন্তু এই বাসাটিতেও হাতে কাপড় কাচার পরিমাণ এত বেশি যে সাহেরা দ্বিতীয়বারের মতন অসুস্থ হয়ে যায়। আমিই নিয়ে যাই আবার ডাক্তারের কাছে, এইবার ডাক্তার কড়া নিষেধ করলেন ভারী কাজ করতে। ওই বাড়ির কাজ সাহেরা ছেড়ে দিলো। এখন শুধু সে আমার কাছেই কাজ করে, মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা দেই তাকে, আর সকালে নাশতা আর দুপুরের খাবার সে আমাদের সাথে খায়। অন্য কাজটি ছাড়াতে সাহেরাকে অনেক বুঝাতে হয়েছে যে সে যদি একেবারে অচল হয়ে পড়ে তাহলে তো আরও বিপদ।
এখন তবু সে কিছু রোজগার করতে পারছে, একদম অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন তাকে দেখবে কে! তার স্বামীকে ডেকে বুঝিয়েছি সাহেরার শরীর খারাপের বিষয়টি। ডাইনিং চেয়ারে বসে কেক আর চা খেতে খেতে বুঝদারের মতন মাথা নেড়েছিল সাহেরার স্বামী আর বলেছিল, ‘তোমরা চিন্তা না করেন আফা, ঘর ভাড়া মুই দিম, টাকার চাইতে সাহেরার শরীর ভাল থাকা বেশি জরুরি।’
খানিক সন্দেহ থাকলেও ভেবেছিলাম হয়তো স্ত্রী’র অসুখে বিচলিত সে কিছুটা ভাল হয়ে চলবে। সাহেরা জানালো, গত দুই মাস ঘর ভাড়া দেয়া হয় নাই। অনেকবার সে স্বামীকে বলেছে, আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে করে সে এক টাকাও ঘর ভাড়া দেয় নাই। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছে। গত কয়েকদিন থেকে এই নিয়ে স্বামীর সাথে লেগেই আছে। গত পরশু সাহেরাকে সে প্রচণ্ড মেরেছে, আর বলেছে ঘর ভাড়া সে দিতে পারবে না, সাহেরা যেভাবে পারে ব্যবস্থা করুক, আর নয়তো যেখানে ইচ্ছা চলে যাক।
আমার ব্যস্ততা দেখে সাহেরা আমাকে আর কিছু বলে নাই। গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা এখনো, সে নিজে নিজেই প্যারাসিটামল খেয়েছে। দেখালো আমাকে হাতে, গলায় কালশিটে পড়ে গেছে। কি বলবো ভেবে উঠতে পারি না। সাহেরা চোখের জল মুছে আবার কাজ শুরু করে। আমি বসেই থাকি। একটু পরে সাহেরা দৌড়ে এসে আমার প্রায় গায়ের উপরে পড়ে যায়। কান্না জড়ানো স্বরে বলে আমাকে, ‘আফা, বাড়ীঅলাক মোর টিপি (টি ভি) খান দিছং, যা দাম হয় ঘর ভাড়া বাবদ রাখুক আর বাকী টাকা সোহানের বাপের (স্বামী) কাছ থাকি আদায় করুক। আর আমি রমজান মাসে দেশ থাকি ঘুরি আসিয়া মুই তোমার কাছে থাকিম। বড় মাইয়া খানের তো বিয়া দেইম রোজার ঈদের পরে। ছোট মাইয়াক মোর মায়ের কাছে থুইয়া আসিম। মাসে মাসে টাকা দিলেই হইবে, আর আমি যদি তোমার কাছে থাকি, তাইলে আমার আর ঘরও নেওয়া নাগবে না, এত যন্ত্রণাও আর সহ্য করা নাগবে না। দেশেও তো নাই কেহ যে মোক বসি খাওয়াইবে। নিজে অজগার (রোজগার) না করলে মাইয়ার ঘরের ( মেয়েদের) পড়া না হইবে আফা!’
ধরে বসাই সাহেরাকে। চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলি, সমস্যা নাই, সে আমার কাছে এখন থেকেই থাকতে পারে তার ছোট্ট মেয়েটি সহ। মনটা বড্ড বিষণ্ণ হয়ে গেল। সাহেরা তার ছোট মেয়েটি অন্ত:প্রাণ। বাসায় কোন ভাল রান্না হলে, কি কিছু ভাল খাবার এলে আমি যতই মেয়েটির জন্য আলাদা করে দেই না কেন, সাহেরা নিজের ভাগেরটুকুও মেয়ের জন্য পোটলা বাঁধে। দিনের মধ্যে কমপক্ষে দুইবার প্রতিবেশীর ফোনে ফোন করে মেয়ের খবর নেয়। এই মেয়েকে গ্রামে রেখে সে কিভাবে থাকবে ঢাকায়! সাহেরার স্বামীর নিষ্ঠুর অবিবেচনার কথা মনে করে অবশ্য অবাক হই না। এই ধরনের নিষ্ঠুরতা বা অবিবেচনা তো শুধু সাহেরার স্বামীকেই করতে দেখছি না। আরও দেখেছি, দেখবও হয়তো ভবিষ্যতে।
ভাবি সাহেরার কথা। দুইবেলা দুই মুঠো খাবার সংস্থান করার জন্য কেন এত কষ্ট তাকে করতে হবে, শুধু গরীব ঘরে মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে? কোন উত্তর পাই না এই প্রশ্নের। কাজ শেষে চলে যেতে প্রস্তুত সাহেরা, তার মেয়ের জন্য এক ফালি তরমুজ, দুটো মিষ্টি দেই। বলি তাকে এখন এসব ভেবে মন খারাপ যাতে না করে। আর স্বামীর সাথে কোন ঝগড়াও যাতে না করে। কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। কি ব্যবস্থা করবো আমি যাতে সাহেরাকে তার ছোট্ট মেয়েটির কাছ থেকে আলাদা না হতে হয়? কি ক্ষমতা আছে আমার? কেন এরকম অবিবেচক হয়েও শুধু পুরুষ হবার সুবাদেই পার পেয়ে যাবে সাহেরার/ সাহেরাদের স্বামীরা?
সাহেরাকে বলা ভরসার কথাগুলো আমার নিজের কাছেই বড় ভারী ঠেকছে!