সোভিয়েত নারীর দেশে-৫

Armenia 2সুপ্রীতি ধর: বিদেশ চলে যাবো বলে সেবার বেশ কয়েকটি বই পেয়েছিলাম আমার বন্ধু মহল এবং দাদার বন্ধুদের কাছ থেকে। এই সুযোগে বলে রাখি, আমার রাজধানী জীবনে দাদার বন্ধুদের অবদান ছিল অনেক, এবং এখনও আছে। ঢাকার রাস্তাঘাট চেনানো থেকে শুরু করে ঢাকার সাংস্কৃতিক জীবন, আন্দোলনের জীবন, সবকিছুতেই তারা ছিলেন আমার অগ্রপথিক। আর আমাদের সময়ে উপহার হিসেবে বই-ই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আরাধ্যও। জন্মদিন থেকে শুরু করে কারণে-অকারণে বই পেতাম। দেশে তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলছে, আর সেই আন্দোলনের অন্যতম নিয়ামক ছিল কবিতার বই। প্রচুর কবিতা পড়তাম আমরা।

মস্কো থেকে ইরেভান যাওয়ার পথে আমার কান্নাকাটি যখন একটু ধরে এলো, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী আর প্রেমেন্দ্র মিত্রই তখন একমাত্র ভরসা। স্যুটকেসে আরও অনেকেই আছেন। তাঁরাও আমার বিদেশ জীবনের সহযাত্রী। কিন্তু পড়ি কী করে? চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে, ঝাপসা হয়ে আসছে কবিতার অক্ষরগুলো। তারপরও পড়ে চলেছি। কোথাও সান্ত্বনা না পেয়ে বইয়ের বাংলা অক্ষরগুলোতে হাত বুলাই আর মাকে স্পর্শ করতে চাই, দেশটাকে ছুঁতে চাই। হয় না। বার বার বুক ভেঙে আসে। কী দু:সহ সেই তিনটা দিন!

মাথা ঝিমঝিম করছে তখন। রাতে ট্রেনে উঠে তেমন কিছুই না খেয়ে একসময়ে দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নাসির একটুর জন্যও ঘুমায়নি। সকালে ওর চোখ দেখি ঢোল হয়ে আছে। আমাকে যতোই দেখে, ততই যেন ওর কান্না বাড়ে। ওর কান্না দেখে আমিই কিছুটা সামলে নিয়েছি নিজেকে। আমার জীবনে এমন কান্নাকাটি করা ছেলে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একে তো বিমানে বমি করেছে, এখন করছে কান্নাকাটি, ওকে নিয়ে যে আমি কী করবো, ভেবেই পাচ্ছিলাম না। মস্কোর দুদিন তো ওকে পাত্তাই দেইনি, তাছাড়া মস্কোতে নাসিরের আপন বড় ভাই জসীম ভাই থাকতেন। কাজেই বিমান থেকে নামার পর আমরা নিজেরাও নাসিরের দেখা পাইনি। আর এখন সে কেঁদে-কেটে একাকার হয়ে চলেছে আমার সাথে।

সকালে মোটা মতোন খালাসম্পর্কিত একজন চা দিয়ে গেলেন কাঁচের গ্লাসে। পরে জেনেছি, উনারাই একেকটি ওয়াগনের দায়িত্বে থাকেন। অদ্ভুত সেই গ্লাসের খোলসটা। চারদিকে রূপালী রংয়ের একধরনের ধাতু দিয়ে বানানো এই গ্লাসদানি। খেতে গিয়ে ছলকে পড়ে গেল চা। চলন্ত অবস্থায় এই জিনিস খায় কী করে ঈশ্বরই জানেন, আমি অন্তত জানি না। তাছাড়া তখনও আমরা ‘র’ চা খেতে শিখিনি। তাই সাথে আনা খাবারগুলোর দিকে হাত বাড়াই। নাসিরকে বলি খেয়ে নিতে। ও আমার কথা শুনলো বলে মনে হলো না। ওর অবস্থা দেখে আমার ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতনের কথা মনে পড়ে গেল। আমি যেন মূহূর্তেই ওর বড় বোনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাম। মোটামুটি ধমকে কাজ হলো। শুকনো কেক খেলাম পেপসিতে ভিজিয়ে। খিদে যত পায়, মায়ের মুখটাও ততোটাই স্পষ্ট হয়ে উঠে আর বুকের পাঁজরে মনে হয় কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে। মা। আহ্, কী মধুর সেই শব্দ!

ট্রেনের টয়লেট ব্যবহার নিয়ে কিছুটা বিড়ম্বনা হয়েছিল বৈকি, সেই কথায় আর না যাই। একে তো চলন্ত ট্রেন, তারপর অপরিচিত সিস্টেম। ভাষা নেই মুখে যে সিস্টেম জেনে নেবো। আমাদের সহযাত্রী দুই মা-ছেলের সাথে চোখের সম্পর্ক একটা গড়ে উঠেছে আমার। বিশেষ করে মা যিনি, তিনি আমার দিকে এমন সস্নেহ ভরে তাকান যে, এই ভালবাসা মুখের ভাষা না জানা থাকলেও যে কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব। তিনি আমাকে এটা সাধেন, ওটা সাধেন। সালাদ ছাড়া তেমন কিছুই ‘কমন’ পড়ে না দেখে এড়িয়ে যাই। সালাদটাই খাই। খিদের পেটে তখন সেই কাঁচা সবজি অমৃত সমান হয়ে উঠে।

এভাবেই কষ্টের দোলাচলে আর ট্রেনের দুলুনিতে আমরা পাড়ি দিতে থাকি হাজার হাজার কিলোমিটার পথ অজানা কোন এক আরমেনিয়ার উদ্দেশে। শুনেছি সেখানে দুজন বাঙালী বড় ভাই আছেন। কিন্তু কেউ তাদের কোন ঠিকানা দিতে পারেননি। তারা নাকি মস্কোর বড়দের ‘নেটওয়ার্কের’ বাইরের।

বিশাল ট্রেন যাত্রার দ্বিতীয় দিনে আমি আর নাসির কোনরকমে নিজেদের সামলে নিয়ে চলাফেরা শুরু করি। ভাষা জানি না, কিন্তু ‘রেস্টুরেন্ট’ শব্দটা দেখলাম সবাই বুঝলো। দেখিয়ে দিল সামনে যেতে। বিপত্তিটা হলো সেখানেই। এক কামরা থেকে আরেক কামরায় যাওয়ার পথ তো সোজা না, দুটো পাতের মতোন আছে, সেগুলো নড়ছে ট্রেনের সাথে সাথে। এই ছোট্ট অথচ কঠিন ‘পাতটুকু’ পাড়ি দিতে দুরূহ ঠেকলো। এমন ছুটন্ত ট্রেনে মানুষ কীভাবে নির্বিঘ্নে পেরিয়ে যাচ্ছে পথ!

যাক্, অবশেষে ভিনদেশি একজন হাত বাড়িয়ে পার করে দিল আমাকে। পিছন পিছন নাসিরও এলো। কিন্তু এখন? খাবার-দাবার কিছুই যে সামনে নেই। কী করে বোঝাবো কী খেতে চাই! করুণ মুখ দেখে একজন এগিয়ে এসে হুড় হুড় করে কী যেন জিজ্ঞাসা করলো। না বুঝে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। ততক্ষণে চোখের কোণে জল জমে গেছে আমার। নাকে আসছে খাবারের গন্ধ, পেট তখন মোচড় দিতে শুরু করেছে, অথচ কিছুই বলতে পারছি না। তাহলে কী না খেয়েই ফিরে যাবো? কী কী শব্দ যেন শিখেছিলাম, ধ্যত্তেরি, প্রয়োজনের সময় এখন তা মনেও করতে পারছি না। নাসিরের ভরসা তো আমিই। সেই আমি কিনা এমন বেকুব!

অবশেষে হাত আর চোখের ইশারাই কাজে দিল। ডিম তো বোঝাতে পারলাম! ওরা সেদ্ধ ডিম দিল, এক মুঠো ভাত দিল, মুরগি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, চাই কিনা! গোগ্রাসে সব খেয়ে নিলাম দুজন। মনে হলো কত যুগ পরে যেন ভাত খেলাম।

এবার মনে অনেক শান্তি নিয়ে কেবিনে ফিরলাম। আমাদের মন যখন ফুরফুরে, তখন সহযাত্রী ছেলেটি কাগজ নিয়ে বসলো। একটা গিরগিটি জাতীয় ছবি এঁকে বোঝাতে চাইলো, এটা আমার দেশে আছে কিনা! চিন্তাশক্তি দিয়ে বুঝে গেলাম, ও আসলে কুমির বোঝাতে চাইছে। যখন বললাম, ক্রোকোডাইল? ও তখন লাফিয়ে উঠলো আনন্দে, ‘দা দা, ক্রাকাজিল’। যাকগে, ক্রোকোডাইল তাহলে ক্রাকাজিল। মিল আছে ভাষায়।

ভিনভাষী চারজনের মধ্যে এখন থেকে হাসি বিনিময় হয়, একের পর এক খাবার দেয় তারা, মনে পড়ে যায় উপদেশের কথা, ‘যা পাবে তাই খাবে, জানতে চাইবে না এটা কী, ওটা কী’। আমিও খেয়ে নিই কিছু জিজ্ঞাসা না করেই। আর এই ভিনদেশি মা দাঁড়িয়ে যান তার সমস্ত মাতৃত্ব নিয়ে। আমাদের কান্নার বেগ কমে আসতে থাকে। যদিও থেকে থেকেই হু হু করে উঠে ভেতরটা, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তারপরও প্রাণ ফিরে পেতে থাকি নতুন ‘স্বদেশে’।

ট্রেন ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, এমনকি সমুদ্রকেও সরে সরে যেতে দেখি। সময় যেন অনন্তকাল ধরে পথ চলতে শুরু করেছে আমাদের সাথে। এই পথের শেষ নেই। কোথায়, কখন সকাল হয়, দুপুর-বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, বুঝতে পারি না। মেইল ট্রেন। ঘড়ির কাঁটা ধরে কোন কোন স্টেশনে থামে, বেশিরভাগই থামে না। কিছু স্টেশনে ‘সোভিয়েত নারী’র প্রচ্ছদের মতোন স্কার্ট আর স্কার্ফ পরা নারীদের থলে হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। কোনো স্টেশনে দীর্ঘ সময় থামে ট্রেন, সহযাত্রী ‘মা’ হাত ধরে নিচে টেনে নামান, ধরে ধরে হাঁটার কথা বুঝিয়ে দেন, শরীর টানা দিতে বলেন। মুখ মলিন দেখলেই জড়িয়ে ধরেন মমতায়। আমি যেন আমার মায়ের গন্ধটাই পাই।

রেললাইনের একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে বিশাল জলাধার। সে এক সৌন্দর্য বটে! জানালা গলিয়ে চোখ বাড়াই, প্রকৃতি যেন তার সব সবুজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর এই প্রান্তে। ট্রেন কখনও কখনও ঢুকে যায় অন্ধকার টানেলে, আবার বেরিয়ে গেলে আলোর মুখ দেখি।

টানা তিনদিনের ট্রেন যাত্রা শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত আমরা পৌঁছাই আরমেনিয়ার রাজধানী ইরেভানে। দুজন ফর্সা, দশাসই চেহারার লোক এসেছেন আমাদের নিয়ে যেতে। মনটা খারাপ হয়ে যায় বাঙালী বড় ভাইয়েরা কেউ আসেনি বলে। যারা এসেছেন, আমি তাদের কোমর সমান লম্বা। মাথা ওপরের দিকে টেনে তুলে তাদের কথা বোঝার চেষ্টা করি।

গাড়িতে আমাদের মাল-সামাল ওই দুজনই টেনে তুললো। তাদের শক্তি দেখে আমি-নাসির হতভম্ব বনে যাই। আমাদের তুলে নিয়ে গাড়ি চললো দেশের ভিতরে আরেক ভিনদেশী রাজধানীর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে। মস্কো ছিল সমতল, এখানে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ। মস্কোতে আমাদের নিতে আসা সেই বড় ভাই-বন্ধুদের ভালবাসা আজ এখানে নেই, বাংলায় কথা বলার আরামও নেই। কিন্তু আছে নতুনত্ব, নতুন গন্ধ, চুপচাপ দেখে যাই মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতির নিজ হাতে ঢেলে সাজানো সৌন্দর্য। ভবনছোঁয়া উচ্চতায় উঠে যাচ্ছি, আবার পর মূহূর্তেই নেমে আসছি নিচে সমতলে। নি:শ্বাসটাও ভারী ঠেকে না, এমনই বিশুদ্ধ বাতাস। আর আছে মস্কোর সোনালী চুলের বদলে কালো চুলের মানুষের সমাহার। অনেকটা নিজের দেশের মতোন।

স্যালুট ইউ, ইরেভান…..।(চলবে)

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.