উইমেন চ্যাপ্টার: শৈশবে কেউ ‘বুলিয়িং’ বা মানসিক হয়রানির শিকার হলে ৪০ বছর পরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে সেই ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। লন্ডনের কিংস কলেজের গবেষকরা সম্প্রতি একথা জানিয়েছেন। গবেষণায় সাত হাজার ৭৭১ জন সাত বছর বয়সী থেকে শুরু করে ৫০ বছর বয়সীদের বেছে নেয়া হয়, যাদের জন্ম হয়েছিল ১৯৫৮ সালে।
দেখা গেছে, শৈশবে যারা প্রায়ই বুলিয়িং বা হয়রানিমূলক মন্তব্যে শিকার হতো, তাদের বিষাদগ্রস্ততা এবং উদ্বেগে ভোগার বাড়তি ঝুঁকি থাকে। সেইসাথে ৫০ বছর বয়সে জীবনযাপনের মানও তেমন উন্নত হয় না।
অ্যান্টি বুলিয়িং গ্রুপগুলো জানিয়েছে, বুলিয়িং এর শিকারগ্রস্তদের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দেয়ার প্রয়োজন আছে। এর আগে ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় ১৪০০ জনেরও বেশি লোক বেছে নেয়া হয়েছিল, যাদের বয়স ছিল নয় বছর থেকে ২৬ বছর বয়সী। এতে দেখা যায়, বুলিয়িং এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মানুষের স্বাস্থ্য, চাকরির অগ্রগতি এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
আমেরিকান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে বুলিয়িং এর প্রভাব মধ্যবয়স পর্যন্ত বিরাজ করতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, তথ্যউপাত্ত জোগাড় করতে গিয়ে তারা অভিভাবকদের কাছে জানতে চেয়েছেন তাদের শিশুরা এমন কোন বুলিয়িং এর শিকার হয়েছে কিনা সাত থেকে ১১ বছর বয়সের মধ্যে। এক চতুর্থাংশ বলেছেন, তারা মাঝে মাঝে বুলিয়িং এর শিকার হয়েছেন, অন্যদিকে শতকরা ১৫ ভাগ বলেছেন, তারা প্রায়ই এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হতেন। এরপর দীর্ঘ বছর ধরে গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেছেন, বুলিয়িং এর পরিচিত প্রভাবগুলো বয়স বাড়ার সাথে সাথে হ্রাস পায়, নাকি আরও মারাত্মক আকার নেয়।
গবেষণায় ২৩ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মানসিক যন্ত্রণা এবং সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখা হয়। এর মধ্যে ৪৫ বছরে তাদের কোন মানসিক সমস্যা আছে কিনা, সামাজিক সম্পর্ক এবং ৫০ বছর বয়সে তারা কেমন আছেন, এসবই পরীক্ষা করা হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, যারা শৈশবে বুলিয়িং এর শিকার হয়েছেন, ৫০ বছর বয়সে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য তেমন ভাল ছিল না, সেইসাথে সাধারণ বোধবুদ্ধিরও কিছুটা অভাব লক্ষ করা গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে বুলিয়িং নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলো বলছে, শৈশবে বুলিয়িং এর শিকার লোকজন প্রায়ই হতাশায় ভুগেন এবং তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। পাশাপাশি সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও তারা তেমন সফলকাম হন না। তাদের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়, প্রায়ই বেকারত্বে ভুগেন, ফলে আয়ও কম হয়। পারস্পরিক সম্পর্কগুলোও মার খেয়ে যায় ব্যক্তিবিশেষে। তবে এ থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় হচ্ছে এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা।
কিংস কলেজ লন্ডনের সিনিয়র একজন গবেষক প্রফেসর লুইস আর্সেনোল বলছিলেন, ‘বুলিয়িংকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। এটা শুধুমাত্র বড় হওয়ার ক্ষেত্রে একটা ছোটখাটো অনুষঙ্গ, তা নয়। শিক্ষক, অভিভাবক এবং নীতিনির্ধারকদের সচেতন হতে হবে স্কুলগুলোতে কি ঘটছে, বাচ্চাদের খেলার মাঠে কি ঘটছে এবং এটা মাথায় রাখতে হবে যে, এসব ঘটনা ‘তুচ্ছ’ নয়, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনে। বুলিয়িং এড়ানোর পাশাপাশি এর শিকারদের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে রক্ষা করতে অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে হবে বলেও পরামর্শ দেন তিনি।
আরেকজন গবেষক বলেন, বুলিয়িং বন্ধ করতে কর্মসূচি গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেইসাথে কিশোর বয়সে বা বড় অবস্থাতেও যেসব কারণ মানুষকে এসব ‘হয়রানি’ ঘটাতে সহায়তা করে, সেই কারণগুলোও খুঁজে বের করতে হবে এবং সমাধানে সচেষ্ট হতে হবে।
অ্যান্টি বুলিয়িং অ্যালায়েন্স বলছে, অভিভাবক, শিক্ষক, শিশু এবং তরুণদের একসাথে কাজ করতে হবে এমন একটি সমাজ গড়তে, যেখানে বুলিয়িং থাকবে না, যেখানে এমন কিছু ঘটলে সাথে সাথে এর প্রতিবাদ জানানো হবে।
তবে গবেষকরা সাম্প্রতিক সময়ের সাইবার বুলিয়িং এর বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, এখনকার তরুণরা সবচেয়ে বেশি হুমকির শিকার হচ্ছে সাইবার প্রযুক্তিতে। আর এটা ভয়াবহ আকার নিয়েছে, শিগগিরই এটা বন্ধ করা উচিত। এ ধরনের হয়রানি ভবিষ্যত প্রজন্মটাকেই ধ্বংস করে দেবে বলেও তারা হুঁশিয়ার করে দেন।
তারা এটাও বলেন যে, শিল্প কারখানা, স্কুল এবং সরকারের ভূমিকা মাথায় রেখে বুলিয়িং এবং সাইবার বুলিয়িং কিভাবে সামাল দিচ্ছে অ্যান্টি বুলিয়িং প্রতিষ্ঠানগুলো, এবং সেইসাথে ক্ষতিগ্রস্তরা যথেষ্ট পরিমাণ উপদেশ/পরামর্শ পাচ্ছে কিনা সেই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করার এটাই উপযুক্ত সময়।