উইমেন চ্যাপ্টার: চিত্রা দেবী বলতেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’…। সেই চিত্রা দেবী তাঁর জীবনের অর্ধেক চলেছেন একা, মানে স্বামীহীন সংসারে। সন্তানরা থাকলেও যে যার মতো করে সবাই ব্যস্ত। তবুও পান থেকে চুন খসলেই ‘তোমার জন্যই সব’ কথাটা মুখে লেগে থাকতো সন্তানদের। কোনদিন তিনি তার সিদ্ধান্ত একা নিতে পারেনি, শুধুমাত্র অফিস যাওয়া আর মাসের শুরুতে বেতনটা তোলা ছাড়া।
চাকরি জীবনের শেষে তাই চিত্রা দেবীকে দেখি, পেনশনের টাকাটাও নিজের মতো করে রাখতে পারেননি, চলে গেছে ছেলের দখলে। প্রতি মাসে যে টাকাটা পেতেন পেনশনের, সেই চেক বইটাও থাকতো বড় ছেলের কাছেই। তাই পুরো মাস তাঁকে হাত পেতেই চলতে হতো। ইচ্ছে করে যে নাতি-নাতনির হাতে দুটো টাকা গুঁজে দেবেন, সেই উপায়ও ছিল না। সেই দিনগুলো খুবই অসহায় লাগতো তাঁকে দেখে। জীবনভর উপার্জন করেছেন যিনি, সংসারের ঘানি টেনেছেন, সন্তানদের সাধ-আহ্লাদ মিটিয়েছেন, সেই তাঁকে শেষবয়সে এসে দেখি কপর্দকহীন।
শেষের কয়টা বছর চিত্রা দেবী শয্যাশায়ী হলেন। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ের জন্যই নাড়ির টানটা একটু বেশি বোধ করি তাঁর। সবাই সেই মেয়েটাকে ছেড়ে গেলেও মা তাই পারেন না, জড়িয়ে রাখের আষ্টেপৃষ্ঠে। পারলে এখনও তিনি আগলে রাখেন জাগতিক সংসারের সব কূটকচালি থেকে। অন্যেরা যখন কথা শোনায়, চিত্রা দেবী তাঁর মেয়ের পাশে বটবৃক্ষের মতোন ছায়া হয়ে থাকেন, বলেন, ‘কর্মফল মানুষকে ভোগ করতেই হয়, দেখিস। তোর কিছু বলার দরকার নেই’।
তো, সেই চিত্রা দেবী যখন বিছানা নিলেন, তখন প্রথমে ছোট মেয়ের বাসাতেই ছিলেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরলেন ছোট ছেলের বাসায়। ইচ্ছে ছিল, ছেলের বাসায় থাকলেও মেয়ের কাছাকাছিও থাকা হবে। ছেলের কাছে তিনি পান খাওয়ার টাকা চান। ছেলের সন্দেহ, এই টাকা মা না খেয়ে ছোট মেয়েকে দিয়ে দেবে। যদিও মামলাটা মাত্র ৫০০ টাকার। তারপরও মায়ের মনে লাগে। তিনি হাত গুটিয়ে নেন। ছেলে মায়ের টেবিলে পান রেখে বলেন, ‘এই যে পান, খেয়ে নিও যত খুশি চাও’। মা পানের দিকে তাকিয়ে থাকেন, পান পাতাগুলো চোখের সামনে পচে যেতে থাকে, মা ছুঁয়েও দেখেন না।
এরই মাঝে একদিন বিপত্তি ঘটে। চিত্রা দেবী বাথরুমে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান। বড়লোক ছেলের বাড়ির আয়তন বিশাল। তাই এক কোণের একটি ঘরে কে পড়ে গেল বা পড়ে থাকলো, তাতে কারও নজর আসে না। মিনিট যায়, ঘন্টা যায়। ঘন্টা তিনেক পর চিত্রা দেবী নিজেই আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে উঠে আসেন বিছানায়। অত:পর ডাক্তার আসে, মাইল্ড স্ট্রোক। ওষুধপথ্যে ছেয়ে যায় টেবিল। ছেলের বড়লোক বন্ধুরাও আসে উনাকে দেখতে। সেই বন্ধুদের ততোধিক ক্রিম-পাউডার মাখানো স্ত্রীদের পারফিউমে ঘরময় মৌ মৌ করে। হাতে তাদের ফলের ঠোঙা। ‘মাসীমা খাবেন এগুলো’। চিত্রা দেবী ম্লান হাসেন, সেই হাসি কেউ দেখতে পায় না।
তিন দিন পর এই খবর আসে ছোট মেয়ের কানে। ছুটে যায় ভাইয়ের বাসায়। নিচে কেয়ারটেকার থামায় তাকে। ফোন করে ওপরে জানতে চায় বাড়িওয়ালির কাছে, ‘স্যারের বোন এসেছে, উঠতে দেবো?’ এদিকে অস্থির, পায়চারি করা ছোট মেয়ের চোখ এড়ায় না, ফোনের ওপারের দীর্ঘ নি:শব্দতা। কিন্তু সে আজ দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। মাকে না দেখে সে ফিরবেই না। অত:পর, কেয়ারটেকারের সম্মতি মেলে। লিফটে উড়ে যায় ওপরের তলায়। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে বাসার গৃহকর্মী। ‘আপনি কি ফুপু’? ওর প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পায় ছোট মেয়ে। কিছু না বলে ভিতরে ঢোকে। ‘মা কোথায়?’ গৃহকর্মী মেয়েটা তাকে একটা ঘরে নিয়ে যায়। মা মেয়েকে দেখে বাচ্চাদের মতোন জড়িয়ে ধরেন। ‘মা, তুই আইছিস? কেমনে আইলি? ওরা তোকে আইতে দিল?’ কত প্রশ্ন।
মেয়ের চোখ গড়িয়ে জল পড়ে, বুকের ভেতরটা ক্ষোভে-দু:খে-কষ্টে শক্ত পাথর হয়। চা আসে, সঙ্গে তিনটা বিস্কুট। মা তখন গৃহকর্মী মেয়েটাকে বলে, ‘ফ্রিজে তো কাল মিষ্টি ছিল, ফুপুকে দে, ও আমার ছোট মেয়ে’। গৃহকর্মী মেয়েটা কিছু না বলে রুম থেকে চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে, ‘আপনে কতক্ষণ থাকবেন?’ চিত্রা দেবী নিজেই সেই প্রশ্নের উত্তর দেন, ‘আমার মেয়ে যতক্ষণ খুশি থাকবে, তুই কে জিজ্ঞাসা করার?’ ‘না, আমি জিগাই নাই’, বলেই সে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। সেইদিন মিষ্টি আর আসেনি। সেই বাড়িটির যে রুমটি মাস্টারবেড, সেটির দরজাও খোলেনি যতক্ষণ ছোট মেয়ে ছিল, ততক্ষণ।
এরপরের ঘটনা ভয়াবহ। তারও দুদিন পর হঠাৎই শোনা যায়, চিত্রা দেবীকে তাদের মফস্বল শহরের নিজে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একে তো স্ট্রোকের রোগী, তার ওপর তাকেঁ প্রায়ই ডাক্তার দেখাতে হয়, তারপরও তাঁকে মোটামুটি জোর করেই গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের দূর বাড়িতে। চিত্রা দেবীর তখন পা নিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা। সামান্য তুলতেও পায়ের পেশিতে টান লাগে। মফস্বলের বাড়িতে টয়লেট ছিল উঠান পেরিয়ে বাড়ির এক কোণে।
জীবনভর সাফসুতরো থাকা, পরিপাটি, অভিজাত চিত্রা দেবী তখন হামাগুড়ি দিয়ে উঠান পেরিয়ে টয়লেটে যান। হাঁটুর ছাল উঠে গেছে, শরীরের এখানে-সেখানে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। কাউকে কিছু বলেন না। ডিম-মাছ খেতে বরাবরই ভালবাসতেন তিনি। এবার বড় ছেলের বউয়ের ওহি নাজেল হয়, ‘এমন বুড়ো বিধবা মানুষ মাছের মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে, লোকে দেখে কী বলবে?’ মাছ বন্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়মেই। সকালের খাবার প্রায় দুপুরে, দুপুরের খাবার প্রায় বিকেলে এসে ঠেকে।
অপরাধ তো অনেক বড় চিত্রা দেবীর। ছোট মেয়ে গিয়েছিল তাঁকে দেখতে, আর সেই সময়টুকু ছোট ছেলের বউকে দরজা বন্ধ করে থাকতে হয়েছে। কাজেই এই বনবাস। একা একা চারটি ছেলেমেয়েকে বড় করতে গিয়ে যে চিত্রা দেবী নিজের সুখের কথা কখনও ভাবতেও পারেননি, জীবন সায়াহ্নে এসে এখন ভাবেন, বড় ভুল করে ফেললাম না তো!