
লীনা হক: গিনেস বুকে বাংলাদেশের নাম উঠেছে, লক্ষ কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছি আমরা। দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, সেনাপতি, মন্ত্রীবর্গ, সংসদ সদস্যবর্গ, নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে শিক্ষক ছাত্র, শিল্পী, চাকুরে, বেকার, দিন মজুর, ব্যবসায়ী, ধনী, নির্ধন, সামরিক বেসামরিক, আম জনতা সবাই শরিক হয়েছিলেন সেই মহান কার্যক্রমে।
এখনো এক মাস হয় নাই সেই রেকর্ড গড়ার। বুকে হাত রেখে, উচ্চ শিরে, দৃপ্ত কণ্ঠে সেই সঙ্গীত গাওয়ার অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত থাকতে পারি নাই। নিজেকে একটু অভাগাই মনে হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের সহকর্মীরা যখন অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন বুক ফুলে উঠছিল গর্বে।
কয়েকদিন আগে ডেইলি স্টার আয়োজিত একটি পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। গত ১৫ বছর ধরে ডেইলি স্টার এটি আয়োজন করে ইংরেজি মাধ্যমের ও লেভেল আর এ লেভেল পরীক্ষায় যারা ভালো ফলাফল করে তাদের পুরস্কৃত করার জন্য। নিঃসন্দেহে চমৎকার উদ্যোগ। ইংরেজি মাধ্যমের এই পরীক্ষাগুলি সারা পৃথিবীব্যাপী একসাথে হয়, একই প্রশ্নমালা। এই সব পরীক্ষায় আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা অনেক ভাল করছে। কেউ কেউ তো ওয়ার্ল্ড সর্বোচ্চ নম্বরও পাচ্ছে। আমার কন্যা গত বছরের (২০১৩) ও লেভেল পরীক্ষায় ৮ টি বিষয়ে এ স্টার পেয়েছে বলে সেও এই পুরষ্কার পেয়েছে। সেই সূত্রে এই অনুষ্ঠানে যাওয়া।
মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানটি হয়েছে। চমৎকার ব্যবস্থপনা। তরুণ ভলান্টিয়াররা সবাইকে যার যার বসার জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছে। মাইকে বার বার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে যেন কেউ মূল অনুষ্ঠান মঞ্চের কাছে গিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা না করেন। সব স্কুলকে ছবি দেয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত, ব্র্যাক ব্যাংকের এম ডি, অস্ট্রেলীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি, ডেইলি স্টার সম্পাদক সবাই ছিলেন। আরও ছিলেন স্কুলগুলোর ছাত্র শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের অবিভাবকরা এবং গণমাধ্যম কর্মীরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ হল। কোরান, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক। সবই ঠিকঠাক। তারপরে জাতীয় সঙ্গীত। মাইকে ঘোষণা দেয়া হল সবাইকে দাঁড়িয়ে সন্মান প্রদর্শন করার জন্য। এবার দেখি, আমার আশেপাশে বেশ অনেকজন দাঁড়াতে অনীহা, কয়েকজন কোল কুঁজো হয়ে দাঁড়ালেন, কেউ কেউ হাঁটু ভাঙ্গা দ হয়ে রইলেন। বেশীরভাগই গাইলেন না। অনেকেই এদিক-ওদিক তাকালেন। অনেকে আবার হাত দুটো নিয়ে ঠিক কি করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না। শেষ চরণটি শেষ হওয়ার আগেই অনেকে বসে পরলেন।
হায়,দু সপ্তাহ আগেই জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি প্রেম প্রকাশে আমরা বিশ্ব রেকর্ড গড়েছি। সেলুক্যাস! বিচিত্র আমাদের প্রেম বোধ! এতো গেল দর্শকসারীর কথা। মূল মঞ্চে দাঁড়ানো অতিথিরাও তাঁদের হাতগুলো নিয়ে একটু সমস্যায় ছিলেন বলেই মনে হল আমার। কেউ কেউ দুহাত দেহের দুপাশে সোজা করে রাখলেন, কেউ কেউ দুই করতল একত্রে বেঁধে হাত দুটো সামনে ঝুলিয়ে রাখলেন, দু একজন হাত দুটোকে আড়াআড়ি করে পেটের কাছ বরাবর একত্রে রাখার চেষ্টা করলেন। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত তাঁর দেশের আচার অনুযায়ী ডান হাত বাম দিকের বুকের উপরে রাখলেন, অস্ট্রেলীয় ব্যক্তিটিও তাই করলেন। বাম দিকেই হৃদয়ের অবস্থান। এরই মাঝে গণমাধ্যম কর্মীরা ক্যামেরা তাক করে খুব সম্ভবত মন্ত্রী মহোদয় এবং অন্যান্য নামী অতিথিদের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়াকালীন মুখের অভিব্যক্তির ছবি নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। দর্শকসারীরও অনেকে গ্যালারি থেকেই সেই চেষ্টা চালালেন।
সব দেখে মনে পড়ল, ময়মনসিংহ রেসিডেনশিয়াল স্কুলে (পরবর্তীতে গার্লস ক্যাডেট কলেজ) যখন ভর্তি হই, প্রথম দিনেই আমাদের শেখানো হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি কিভাবে সন্মান দেখাতে হবে। মাথা উঁচু করে সামনের দিকে দৃষ্টি, দু হাত সোজা করে দেহের দুই পাশে- এলিয়ে দিয়ে নয়, ‘তৈরি’ ভঙ্গিতে রাখতে হবে। আমাদের শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক প্রথমে ছিলেন করিমা আপা, পরে একজন আর্মির এডজুটানট। দুজনে সেই যে তৈরি করেছিলেন আমাদের মন- আজো যখনই, যেখানে, যে অবস্থাতেই জাতীয় সঙ্গীত কানে আসে, মন এবং শরীর দুটোই দাঁড়িয়ে পড়ে সন্মান প্রদর্শনের জন্য। চেষ্টা করেছি যাতে আমার পুত্র-কন্যা দুইজনই শিখে এটি মন থেকেই।
কয়েকদিন আগে, সন্ধ্যে বেলায় ঘরের কাজ কর্ম করছি, টিভি চলছে, মেয়ে কি একটা বায়না নিয়ে আমার পিছু পিছু ঘ্যান ঘ্যান করছে। হঠাৎ তার সাড়াশব্দ না পেয়ে তাকিয়ে দেখি মেয়ে আমার টিভির সামনে মাথা উঁচু করে দুহাত পাশে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো। টিভির পর্দায় নজর করি, টি টুয়েন্টি ফাইনাল ম্যাচ, ওই সময় শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল। দাঁড়িয়ে পড়ি মেয়ের পাশে, নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠে অকারণে।
আচ্ছা, এতো টাকা খরচ হল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি কিছু টাকা খরচ করতে পারে না স্কুল-কলেজগুলোতে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে সন্মান প্রদর্শনের সঠিক নিয়মটি শেখাতে? পরিবারগুলোতে কি একটু শেখানো যায় না সন্তানদেরকে? সৌন্দর্য বর্ধনকারী সাবান অথবা মুঠো ফোন কোম্পানিগুলো এই বিষয়ে প্রচারণা চালাতে পারে না যাতে দেশের আপামর জনগণ সঠিক দেহভঙ্গিমাটি শিখে নেয়? আর গণমাধ্যমের কর্মীরা যদি জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে ক্যামেরা তাক করে দৌড়-ঝাঁপ না করেন তাহলে দায়িত্বপালনে অবহেলা হবে?
এতো চমৎকার একটি অনুষ্ঠান ছিল, কিন্তু শুরুতেই মানুষের এই আচরণ কেমন যেন এক ধরনের কুশ্রিতা ছড়িয়ে দিল। কেন যে আমরা এখনো নিজেরা-নিজেরাই একটু খানি সভ্য-সুন্দর হয়ে উঠতে পারি না!