আমি যখন একজন ‘টোকাই’ এর মা

Dhanmondi Mathhসুপ্রীতি ধর:

ধানমন্ডি আট নম্বর মাঠ নিয়ে নাটক বেশ ভালো জমে উঠেছে। মাঝে পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামীকে অপহরণ নিয়ে কিছুটা কালক্ষেপন হলেও মাঠ সংক্রান্ত আন্দোলন আবার দানা বেঁধে উঠেছে। গত দুদিনে আমরা বিলক্ষণ তৎপরতা লক্ষ্য করেছি। মাঠের অধিকার নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে এখন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী এবং শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবের কর্মকর্তারা।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, ধানমন্ডি আট নম্বর মাঠ হিসেবে পরিচিত এই স্থানটি শেখ জামালের নাম ব্যবহার করে কিছু ক্রীড়া সংগঠক ‘দখলের পাঁয়তারা’ করছেন। এলাকাবাসীর জন্য মাঠটি উন্মুক্ত করে দেয়ারও দাবি জানিয়ে আসছেন তারা।

অন্যদিকে শেখ জামালের কর্মকর্তারা বলছেন, এই মাঠ ‘অভিজাতদের’, সাধারণদের এখানে আসতে হবে কেন? ক্লাবের সভাপতি মনজুর কাদের যে শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন, তাহলো, “এই মাঠ ‘এলিটদের’ জন্য, ‘টোকাইদের’ জন্য নয়।

শনিবার পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছে দুপক্ষই। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছেন, “আমরা খেলার বিপক্ষে নই, মাঠ দখলের বিপক্ষে। সাধারণ মানুষ এই মাঠে গিয়ে খেলতে পারবে না, তা হতে পারে না”।

একপক্ষের দাবি, “জনগণের জন্য মাঠটি উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্যই আমাদের এই আন্দোলন। কেউ এই মাঠ দখল করে রাখার অধিকার রাখেন না।” তখন অন্যপক্ষ এই বলে সোচ্চার যে, “আইয়ুব খান এলিটদের জন্যই ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা তৈরি করেছেন। তাই এলিটরাই এই মাঠে এসে খেলার অধিকার রাখেন। কোনো টোকাই এখানে এসে খেলতে পারে না।”

ঠিকই তো, এই মাঠ তো অভিজাতদেরই, অভিজাতদের পূর্বসুরী আইয়ুব খান রেখে গেছেন তাদের জন্য, সেখানে আমাদের মতোন টোকাই আম-জনতার কী অধিকারই বা আছে বচসা করার? ভালো তো, ভালো না? এই ক্যাচালের মধ্যেই মনে পড়ে গেল গতবছরের একটি দিনের কথা।

আমার ছেলে এবং তার বন্ধুরা প্রতিদিন সকালে ধানমন্ডি মাঠে খেলতে যেতো। ওরা নিজেরা নিজেরা মিলে ইংলিশ ফুটবল ক্লাবের আদলে ক্লাব বানাতো। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে জার্সি বানিয়ে আনতো বায়তুল মোকাররম থেকে। নগর জীবনে কোথাও কোন বিনোদন দিতে পারি না সন্তানদের, তাই অনেকটা উৎসাহই জুগিয়েছি তাদের এই কর্মোৎসবে।

কিন্তু একদিন মন খারাপ করে ফেরত এসে বললো, ধানমন্ডি মাঠে আর খেলতে দেবে না। ওদেরকে নাকি ঢুকতে দেয়নি। বলেছে, বড় বড় ক্লাব ছাড়া এখানে কারও খেলা নিষেধ। আমার সেদিনকার ছেলেটার মুখটা এখনও ভাসে। কি করুণ চাহনি ছিল তার চোখে-মুখে। আর কী অপমান বুকে! ওর নিশ্চয়ই তখন মনে হয়েছিল, আমার মায়ের কেন ‘ক্ষমতা’ নেই এই অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার!

এটাও বলেছিল, মা, তুমি কি একটা নিউজ করতে পারো না এটা নিয়ে? আমি বলেছিলাম, দেখি বলে-কয়ে। অবশ্য আর বলা হয়নি। একদিন সে বলেছিল, তুমি কোনদিন প্রধানমন্ত্রী হলে মাঠগুলো ফিরিয়ে দিও। বেচারা। টোকাইয়ের মা যে টোকাই-ই হয়, এটা ওর জানা নেই। এদিকে ছেলে এবং তার বন্ধুরা তখন শুরু করলো স্ট্রিট ফুটবল খেলা। কেনা হলো বিশেষ জুতা। কয়েকদিন গেল, এটাও বন্ধ হলো রাস্তায় চলাচলকারীদের আপত্তির মুখে। এরপর ওরা গেল বন্ধুদের বাসার ছাদে। আমি এসব শুনে আমার অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। ছাদে রেলিং আছে তো? কত উঁচু সেই রেলিং? মাথাতেও ঢোকে না ছাদে ফুটবল খেলা হয় কী করে!

মনে পড়ে যায় ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের ছাদে ফুটবল খেলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল আমার মামাতো ভাই। ১৯দিন তার জ্ঞান ছিল না। এসব কথা মনে করে আমি শুধুই প্রমাদ গুণি। কিন্তু কিশোর বয়সের চাপল্য রোধের কোন শক্তিই যে আমার নেই। ওরা কিভাবে যেন বিভিন্ন ক্লাবের টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। কিছু বড় মানুষ এগিয়ে আসেন তাদের সাহায্যে। একদিন বিশাল এক সাইজের ট্রফিও আসে বাসায়। এটা নাকি সব খেলোয়াড়ের বাসায় এক সপ্তাহ করে রাখার নিয়ম হয়েছে। আমি সেটার দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, ইস্ একটা মাঠ যদি ওরা পেত, তাহলে হয়তো ওদের মধ্য থেকেই ভালো ফুটবলার বেরিয়ে আসতো। দেশের ফুটবলেরও সুনাম হতো। কে জানে!

কিন্তু দৈনন্দিন পেশাগত ব্যস্ততায় ভুলে যাই ছেলের মাঠে খেলতে না পারার কষ্ট। ছেলেকে দেখি জার্সিগুলো মাঝে মাঝে পরতে, জুতা তো শু র‌্যাকে স্থান পেয়েছে অনেকদিন হলো। বেশ দাম দিয়ে কেনা সেই বুটে এখন ধুলাবালির আস্তরণ। আকারে বড় হতে থাকে ছেলে, কৈশোর পার হতে থাকে দ্রুতগতিতে। ফুটবল ছেড়ে তার হাতে উঠে আসে কীবোর্ড। প্রথম প্রথম নেশা না থাকলেও এখন রাতভর সে পড়ে থাকে ইন্টারনেটে, কীসব অদৃশ্য শত্রু নিধনে ব্যস্ত সে এবং তার বন্ধুরা। একে মার, ওকে ধর, ছুরি চালা, ডেগার দে, বন্দুক কই, এসব শব্দ কানে ভেসে আসে মাঝরাতে পাশের রুম থেকে। আমি হতাশ, অক্ষম মা কেবল পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমটাকে প্রলম্বিত করি।

আজ যখন সেই মাঠ নিয়ে বিতর্ক জমে উঠেছে, আমি চাই এটার একটা সুরাহা হোক। আমার প্রবাসী বন্ধুদের একজন বলেছিল, ছেলে খোলামাঠে দৌড়াবে, এই দৃশ্য দেখতেই নাকি সে কানাডা পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু আমরা যারা বন্দী হয়ে আছি এই দেশে, যাদের কোন বিকল্প নেই এখানে থেকে ‘দেশপ্রেম’ দেখানো ছাড়া, সেই আমরাই কি চেয়েছিলাম, আমাদের সন্তানের ভগ্ন স্বাস্থ্য, ভগ্ন মানসিকতা নিয়ে বড় হোক? চাইনি, এখনও চাই না।

তাইতো আজ আবারও আন্দোলনের মাঠে নামতে রাজী আছি আমি। রাজী থাকার একটাই কারণ, আমার অছিলায় যদি আবারও ছেলেরা প্রাণ ফিরে পায় মাঠে নেমে….আমার ছেলের সামনে যদি কিঞ্চিত হলেও মাথা উঁচু হয় আমার!!! আমার মনে হয়, এই ইস্যুতে সবারই আজ সোচ্চার হওয়া উচিত। এটা মগের মুল্লুক নয় যে যা খুশি করে যেতে পারবে। এটা স্বাধীন দেশ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল এখন ক্ষমতায়। তাই কেউ শুধুমাত্র ‘নাম’ ব্যবহার করে যেন সুবিধা নিতে না পারে, সেদিকেও নজর দিতে হবে সরকার বাহাদুরকে।

শেয়ার করুন: