সাহেরা কথা – ১১

Bangali nariউইমেন চ্যাপ্টার: মানুষের জীবনে তার বেড়ে ওঠার পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব সারাজীবন ধরে রয়ে যায়। ছোটবেলায় চৈত্র সংক্রান্তির আগে ঘর বাড়ী পরিষ্কার করতেন মা কাকী। দাদী তদারক করতেন। সেই রীতি আচারের প্রভাব আমার মধ্যে এখনো বহমান। তবে আমার সংসারে আমিই কর্মী, আমিই তদারককারী আর সাহেরা আমাকে সাহায্যকারী। গত কদিন থেকেই পরদা, চাদর এমনকি আমার কন্যার টেডি বিয়ারগুলোকেও ধুয়ে রোদে শুকানো হচ্ছে।

এই সফট টয়গুলোকে ধোয়াটা বেশ মজার, কুসুম গরম সাবান জলে চুবিয়ে একটু ব্রাশ করে নিলেই চকচকে। আমার মেয়ের ভাষায় টেডিদের বাৎসরিক স্নান পর্ব। এই কাজটি সে বেশ উৎসাহের সাথে সাহায্য করে। ফোন করে বন্ধুদেরকে খবর দিচ্ছে কোন দিন কাকে কাকে (প্রতিটা ভাল্লুকের নাম আছে) স্নান করানো হচ্ছে, ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করছে। কিন্তু অন্যকাজগুলি যেমন ঝুল ঝাড়া থেকে শুরু করে ফ্রিজের ভেতর পরিষ্কার করা সবই চলছে সাহেরার সহায়তায়।

সাহেরা আমার সাথে কাজ করতে করতে বক বক করে। পহেলা বৈশাখের এতো আয়োজন সে ঢাকা শহরে আসার আগে কোনদিন দেখে নাই। নুন আনতে পান্তা ফুরনো সাহেরার পরিবারে ঘরদোর লেপা মোছাই ছিল একমাত্র বর্ষবরণ প্রস্তুতি। রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে অতি দরিদ্র তাদের দুই গ্রাম পরে ‘চড়কের মেলা’ হয় যেখানে ‘হেদু’র ঘর (হিন্দু ধর্ম অবলম্বীরা) পূজা করে, কিন্তু মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত। ছোট বেলায় দু’একবার মেলায় সে গিয়েছিল বাবার হাত ধরে। নাগরদোলায় চড়েনি সে, তবে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার স্মৃতি উজ্জ্বল এখনো। বিয়ের পরে আরও দারিদ্রে বসবাস করতে করতে এসব সে ভুলেই গিয়েছিল। ঢাকায় এসে এই রকম আড়ম্বরের বৈশাখ উদযাপন দেখে তার ‘টাসকি নাইগবার ধরছিল’!

প্রথম যখন ঢাকায় আসে, স্বামীর রিকশায় চড়ে সে মহাখালী টিবি গেটের মেলায় গিয়েছিল। এখন তো বেশ কয়েক বছর টি এন্ড টি মাঠেই মেলা বসে। ‘আফা, তোমরা পন্তা খাইবেন না ইলিশ ভাজা দিয়া?’ সাহেরার প্রশ্নের উত্তরে হাসি,’ না সাহেরা, পন্তা খাইলে হামার গুলার ঠাণ্ডা নাগে’! সাহেরাও হাসে, আমার ‘অমপুরি (রংপুরি) ভাষা শুনে। এদিকে মেয়ের আবার বিশাল তোড়জোড় নববর্ষ উদযাপনের জন্য। তার স্কুলের মাঠে বৈশাখী মেলা হচ্ছে। লাল রঙের শাড়ী কেনা হয়েছে,শাড়ীর সাথে রঙ মিলিয়ে চুড়ি মালা দুল! শাড়ী পরার রিহার্সালও হয়েছে, তারপরেও মায়ের উপরে তার ভরসা প্রায় শূন্যের কোঠায়।

‘মা, তুমি পারবে তো শাড়ীটা ঠিকমতো পরিয়ে দিতে?’ হায় তবু ধরনী দ্বিধা হয় না আমার জন্য। এদিকে সাহেরা জানতে চায়, সাহেরাসহ সবার জন্য কাপড় কেনা হলো, এমনকি ‘খিরিসটান’ ড্রাইভারের (সাহেরার মতে কোন ক্রিশ্চিয়ানই বাঙ্গালী নয়) জন্যও ফতুয়া এলো, কিন্তু আমি কেন নুতন শাড়ী কিনছি না! আবারো হাসি, সাহেরা গো সাহেরা, এই গরমে নুতন শাড়ীতে আমার হাঁসফাঁস লাগে যে!

সাহেরা একটু দমে গিয়ে বলে, ‘তোমরা আফা দুনিয়া ছাড়া একখান মানুষ হইছেন! নিজের কতা ভাবা নাগে আফা!’ সাহেরা মাঝে মাঝে এতো চমকে দেয়া জ্ঞানী কথা বার্তা বলে। সাহেরা সহ বাজারে গিয়ে তরমুজ, মিষ্টি কিনি সাহেরার জন্য, বাড়ীর গার্ড দারোয়ানদের জন্য বৈশাখের উপহার হিসাবে। এইটুকুই সাধ্য। আমার সাথে ঢাকা শহরের সুপার স্টোর বা চেইনশপে বাজার করতে আসাটা সাহেরার জন্য বেশ বিনোদন। আগে আমি শাক সবজিও প্রায় এক সপ্তাহের জন্য কিনতাম। কিন্তু এখন আর উপায় নাই, প্রতিসপ্তাহে একবার বাজারে আসতেই হয়, প্রয়োজনের চাইতেও বেশী সাহেরার আগ্রহের কারণে। একটা ট্রলি নিয়ে সাহেরার ব্যস্ত ভাব দেখতে মজাই লাগে। পহেলা বৈশাখের দিন ভোরে সেজেগুজে আমার কন্যা চলে গেল স্কুলে। আমি আর কি করি টিভি দেখা ছাড়া। বোনের বাড়ীতে যাব সন্ধ্যাবেলায়। সাহেরা এলো ১০ টার দিকে। আগেই বলে রেখেছিল সে সকালে টি এন্ড টি মাঠে পহেলা বৈশাখের গানের অনুষ্ঠান দেখে তারপরে আসবে। দরজা খুলে নুতন কাপড়ে, সজ্জিত চুলে সাহেরাকে খুব সুন্দর লাগে। বলিও সেই কথা।

লজ্জিত হয়ে হাসে সাহেরা, ‘কি যে তোমরা কোন বাহে! নিজে তো ক্যাঙ্কা আউলা ঝাউলা হয়ি আছেন!’ সাহেরার হাতে একটা ব্যাগ, জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে শুনি,’ মোর দেওরা আইছে বাড়ী থাইকা, মোর মাও মুড়ি আর গুড় দিছে ওমার হাতত, তোমার জন্য মুড়ি আর গুড় এটুখানি ধরি আসলাম।‘ ভালো লাগায় মনটা আসলেই ভরে উঠে।

সাহেরা জানে আমি দেশী মুড়ি পছন্দ করি। নুতন কাপড় নষ্ট হতে পারে তাই অন্য আরেকটি জামা পরে কাজে লেগে যায় সাহেরা। আমি টিভিতে মগ্ন। সাহেরাকেও ডাকি নাশিদ কামালের গাওয়া ’কমলায় নৃত্য করে’ গানটি শোনার জন্য। সাহেরা খুশী হয়ে বলে উঠে,’ যাই তোমরা কহেন আফা, ওমপুরের ভাওয়াইয়া গানের কাছে কিছু লাগে না।‘

সায় দেয়া ছাড়া উপায় কি। দুপুরে খাবার টেবিলে দেখি একটা ছোট বাটিতে আলাদা করে রাখা পান্তা ভাত, পাটশাক আর সিঁদল (কচুর শাক দিয়ে শুঁটকি মাছের একটা ধরন) ভর্তা। সাহেরা নিয়ে এসেছে আমার জন্য তার বাসা থেকে।

সাহেরা বলে ’তুমি তো সবার জন্যি উপহার কিনলেন আফা, আমিতো আর কিছু পারিম না তাই পন্তা দুইখান তোমার জন্য ধরি আসছি আফা। পাটাশাক আর হিদল ভর্তা দিয়া খান তোমরা।‘

পছন্দের পাটশাক দিয়ে ভাত খেতে গিয়ে গলার মধ্যে ব্যথা বোধ করি। চোখটাও জ্বলে যেন একটু। আত্মার বন্ধনেই হয় আত্মীয়তা, রক্তের সম্পর্ক সেখানে গৌণ বা কোন ভূমিকাই রাখে না, আমার সাহেরা আবারো সেটা মনে করিয়ে দিলো।

শেয়ার করুন: