সুপ্রীতি ধর: ৬ অক্টোবর, ১৯৮৬। রওনা হয়েছিলাম বাংলাদেশ সময় বিকেলে। এরোফ্লোটের চাকা মস্কোর রানওয়ে যখন স্পর্শ করলো তখন হাতঘড়িতে মধ্যরাত। দেশের বিমানবন্দরেই দেখা হয়েছিল আমার মতোন ১৬ জনের একটি দলের সাথে। সেই গ্রুপে মেয়ে আমি একাই। সবার মুখচোখ কেমন যেন ফ্যাকাশে লেগেছিল সেদিন। ওই বয়সে একটা অজানা-অচেনা, ভাষা না জানা দেশে যাওয়ার অনুভূতি কেমন হতে পারে, যে গেছে সেই কেবল জানে।
তবে এই দলের ভিড়েও নিজেকে একটু স্মার্ট মনে হচ্ছিল। একে তো আমি ততোদিনে রাজধানীর মেয়ে, দুই বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির কল্যাণে দুই মাস রুশ ভাষা কিছুটা আয়ত্ত করে নিয়েছিলাম। ফলে বেশ পট পট করছিলাম নিজের পাণ্ডিত্যে। ‘কোন অসুবিধা হবে না, আমি জানি’ এসব নানা কথা বলে নিজেকে জাহির করছিলাম, আর সেই ১৫ জন কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাচ্ছিল আমার দিকে, যেন ভাষাটা না শিখে আসা তাদের জন্য অন্যায়ই হয়ে গেছে। কিন্তু আমার সেই পটপটানি যে অচিরেই মিইয়ে যাবে, তখন কে জানতো!
সাধারণত সোভিয়েত ইউনিয়নে সেশন শুরু হয় সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকে। শিক্ষার্থী যা যাওয়ার, তারা আগেই চলে যায়। আমি গিয়েছিলাম অক্টোবরে, মানে পুরো একমাস জীবন থেকে হারিয়ে ফেলে। এর পিছনে ছোট্ট এক কাহিনী হ্যায়।
আমার বৃত্তিটা ছিল বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির। সেবার আমাদের ২৯ জনের একটা গ্রুপ ছিল। আমাদের যাওয়ার কথা ছিল ১৮ আগস্ট। সেভাবে তৈরিও হয়েছিলাম সবাই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নেয়াও সারা। স্যুটকেস ভর্তি কাপড়-চোপড় আর খাবার। কথামতো ১৭ আগস্ট গেছি পাসপোর্ট-ভিসা আনতে। ২৯ জনের সবাই উপস্থিত। সবাই একে একে পাসপোর্ট-ভিসা পেয়ে সেকী খুশি! কিন্তু আমার ভিসাটাই নাকি নেই। নেই নেই নেই, আসেইনি। মস্কো থেকেই নাকি আসেনি। কে জানে! পরে অবশ্য অন্য কথা শুনেছিলাম, সে যাই হোক। মুহূর্তেই ওই ২৮ জনের খুশি উবে গিয়েছিল আমার মুখ দেখে।
আমার পা যেন কেউ মাটির সাথে পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছিল, আর নড়ে না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সময় যত যাচ্ছে, আমার অবস্থাও খারাপ হচ্ছে। কেউ কেউ চলে যাচ্ছে, বাসায় তাদের অনেক কাজ। কাল চলে যাচ্ছে তারা। আর আমি? আজ আর নাম মনে নেই, দু’একজন রয়ে গেল আমার সাথে।
ওরা বলাবলি করছিল, আমাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না, যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসি! এদিকে আমার বিদায়ী ডিনারে যাওয়ার কথা পঙ্কজ ভট্টাচার্যের বাসায়। আমাদের দুই ভাইবোনের বিদায় উপলক্ষে এই নিমন্ত্রণ। আমি যাবো রাশিয়ায়, আর দাদা যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে। সবাই অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু আমি সেখানে নেই। তখন তো মোবাইল ফোনও ছিল না। আমার দাদা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষার পর নিজেই চলে আসে মৈত্রী সমিতির অফিসে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আমার পরদিন যাত্রা করা বন্ধুরা। আমাকে প্রায় ধরাধরি করে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল ডিনারে। তখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কেউ না থাকলে হয়তো আমি মরেই যেতাম। তবে সে যাত্রা মরে গেলে আজকে আর এসব লেখা হয়ে উঠতো না আমার।
যাওয়াটা এভাবে মাঠে মারা গেল, এদিকে আমার ভবিষ্যত তখন প্রায় অনিশ্চিত। দাদা চলে যাচ্ছে, ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের স্কলারশিপ নিয়ে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও ভর্তি হইনি। সমূহ অন্ধকার থেকে টেনে তুললো দাদার কিছু বন্ধু। যার মধ্যে পরিচিত মুখ নাঈমুল ইসলাম খান একজন। তাদের কল্যাণে লেট ফি দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম, ততোধিক মনমরা হয়ে ক্লাসও শুরু করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিন্তু মন কী বসে? বিশেষ করে বন্ধুদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো আমি সবসময় চোরের মতোন থাকি, এই বুঝি আমাকে দেখে ফেললো! দেখলে কী জবাব দেবো! আরও বেশি মন খারাপের কারণটা এখন মনে হলে একা একাই হাসি। তখন মন খারাপ করেছিলাম এই ভেবে যে, রাশিয়ায় যাওয়া হলো না, আমার আর স্কার্টও পরা হলো না। এদিকে গোছানো স্যুটকেসটাও খোলা হয় না কী ভেবে যেন। মা প্রতিদিন বলে, খুলে সব নামিয়ে রাখ। আমি নির্বিকার। কে জানে, আমার ষষ্ঠনেন্দ্রিয় কোন কথা বুঝে রেখেছিল!
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে খুব সম্ভবত ফোন কলটা পাই মৈত্রী সমিতি থেকে, ‘ভিসাটা এসেছে, যেতে রাজী থাকলে যেন যোগাযোগ করি’….লাফ দিয়ে উঠি আমি। ফোনটা ছিল দোতলায় বাড়িওয়ালার বাসায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারছিলাম না, পায়ের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারানো সেই আমি প্রজাপতির ডানায় ভর করে এসে মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।
মা যেন নতুন জীবন পেয়েছিলেন সেদিন। যাক্, মেয়েটার একটা গতি হলো ভেবে। দ্রুত খবর দেয়া হয় সব আত্মীয়স্বজনকে। চলে যাচ্ছি আমি। পাসপোর্ট-ভিসা সব এবার আমার হাতে, আর সংশয় নেই। দেড় মাস আগে মস্কো চলে যাওয়া বন্ধুদের মুখগুলো স্মরণ করি। মনে মনে বলি, আমিও আসছি। সেই আমি অবশেষে মস্কো পৌঁছালাম শীতের আগমনী বার্তাবহনকারী এক ভোররাতে।
অক্টোবরের মস্কো তখন আমার অপেক্ষায়, আমি উড়ছি, উড়ছি। ‘মা’ এর লেখক মাক্সিম গোর্কি, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, তুর্গেনেভ, পুশকিন, মায়কোভস্কি, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের দেশ তখন আমার জাগরণে-স্বপ্নে। প্রিয় পাঠককূল, ধৈর্য ধরুন, আরও পরের দিকে আমি হেঁটে বেড়াবো আমার গল্পের পরিচিত স্পটগুলোতে, খুঁজে ফিরবো আমার শৈশব-কৈশোর আর সদ্য তারুণ্যের উদ্দামতাকে।
দেশ থেকেই শুনে এসেছি বিমানবন্দরে আমাদের নিতে আসবে কারা যেন। তবে এ নিয়ে আমার কোন দু:শ্চিন্তা ছিল বলে আজ আর এখন মনে করতে পারছি না। বিদেশযাত্রার স্বপ্নে তখন এমনই বিভোর যে, কেউ না এলে ওই ভিনভাষী দেশে আমার কী অবস্থা হতো, তা ঠাহর করারও উপলব্ধি আমার ছিল না।
মস্কো বিমানবন্দরে নেমেই দেখি অনেকগুলো কালো মুখ, সবার পরনে জ্যাকেট। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ হাত নাড়লো, ‘এদিকে’। শুনি তারা বাংলাতেই কথা বলছেন। এবং আমার নামটাও আমি স্পষ্টই শুনলাম তাদের মুখে। সেই তখন, ঠিক তখনই সেই অপরিচিত মানুষগুলোকে আমার খুব কাছের বলে মনে হলো….রক্তীয় না হয়েও তারা হয়ে উঠলো আমার পরম আত্মীয়। ওই ভিড়ে পরিচিত মুখ বলতে ছিল ‘তপু’। লম্বা বলে সবার শেষে দাঁড়ানো থাকলেও ঠিকই চিনে নেই ওকে।
আমাদের সবাইকে নিয়ে লাল রংয়ের একটা ‘ইনট্যুরিস্ট’ বাস (দেশের লাল রংয়ের বিআরটিসি বাসগুলোর মতোন অনেকটা) ছুটলো মস্কোর শেরেমেতিয়েভা বিমানবন্দর থেকে। শীত আসার আগে শরৎ এসে প্রায় খালি করে দিয়ে গেছে প্রকৃতিকে, বর্ণিল পাতা তখনও লেপ্টে আছে গাছের গোড়ায় গোড়ায়, তারপরও কিছু গাছে সবুজ রং তখনও অবশিষ্ট ছিল। বিশাল আকারের ইউক্যালিপটাসগুলো যেন আমাকেই স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়েছিল রাস্তার দুধারে, শুনশান রাস্তাঘাট, ভেজা ভেজা সকাল, অফুরন্ত পথ…..মস্কো, তুমি কতদূর? কিছু ছেলে দীর্ঘ বিমানযাত্রায় কাহিল, বাসে উঠে তাদের মুখ থেকে কথা আর সরে না। একজন তো প্লেনের ভিতরেই বমি করেছে বেশ কয়েকবার। নিতে আসা বড় ভাইয়েরা কতকিছু বুঝিয়ে যাচ্ছে সবাইকে।
সেসব কথা শোনার মন আমার নেই, চোখ মেলে আছি জানালা গলিয়ে বাইরে। বন্ধু তপু আমাকে তখন থেকেই গাছপালা, লতাপাতা চেনানোর দায়িত্বটা নিয়ে নিয়েছিল যেন।
এখন আর ঠিক মনে নেই সেই সময় আমার মনে কী ঘটছিল! আমার কি খুব আনন্দ হচ্ছিল স্বপ্ন পূরণের কারণে? নাকি মনটা হু হু করছিল প্রিয়জনদের ছেড়ে আসায়? কোনটা?
(চলবে)