অড্রে হেপবার্ন ও গ্রেগরি পেক

mourn picঅপরাহ্ণ সুসমিতো: ছেলে কাস্টমসে চাকরি করে দেখে বিয়ের প্রস্তাব বাসায় আসতেই বাবা রাজী হয়ে গেলেন। আমার বাবা একটা বেসরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। সারাজীবন সংসারের বোঝা টানতে টানতে ঢেড়শ নোয়ানো ক্লান্ত। আমার মা আরও সাধারণ। উপজেলা অফিসার্স ক্লাবে যেতে দ্বিধা করেন তার খুব গরিবানা পোষাকের জন্য।

আমি তখন লোকপ্রশাসন বিভাগ, ২য় বর্ষে । ভাগ্যিস ঢাকায় মামার বাসা ছিল। আমার বাবার পক্ষে হলে রেখে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো সম্ভব ছিল না। আমার গায়ের রঙ কালো বলে মামী আমাকে প্রায়ই সানন্দা’র রুপচর্চা বিভাগ পড়তে দিতেন। বিজ্ঞাপনের পাতায় এত সুন্দর সুন্দর মডেল দেখে আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, মেয়েগুলো কি অন্য গ্রহের?

কমলার খোসা বেটে মুখে দিতাম, শসার চাকতি কেটে চোখে, মসুরীর ডাল ধোয়া পানি দিয়ে মাথা ধুতাম। আলু বাটা, পুদিনা চা, উপটান..কি করি নাই আমি ফর্সা হবার জন্য।

মুখে উপটান মেখে আমি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পড়তাম। গলায় আলুবাটা মাখিয়ে রোদে ঝিম মেরে থাকতে থাকতে পলিটিক্যাল ইকোনোমিকসের নোট মুখস্থ করি। রোদ বাড়ে,আমার মুখের চামড়া টনটন করে। কী জানি মাঝে মাঝে চোখ ভিজে যায়। কান্না বুঝি আমার সাথে একাকী তীর্থ যাত্রী !

ছেলে পক্ষ আমার ছোট বোনকে প্রায় পছন্দ করে ফেলেছিল। ছোটবোনটা অসম্ভব চালাক, সুন্দর, স্মার্ট। লুকিয়ে প্রেম করতো। আমাকে প্রায় বলতো,

: বড়পু তুই বিয়ে না করলে তো আমার কিছু হবে না। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল। ইউনিভার্সিটিতে পড়িস, একটাও প্রেম হলো না তোর ?

খুব লোনলি আর অসহায় লাগতো। এই আমি কি এত অসুন্দর ? কোনো ছেলে কি আমার দিকে তাকিয়ে ঝরা পালকের গান শোনাবে না কোনোদিন ? এত মন খারাপ হয় আমার।

ছোট বোনটা কিভাবে যেন কাস্টমসের ছেলেটাকে জানালো যে তার প্রেম আছে। বড়পু খুব মেধাবী ও খুব মমতাময়ী। আমি নাকি দুনিয়ার রান্না জানি। তাছাড়া ছায়ানটে গান শেখার কারণে আমি নাকি কিন্নরী। চশমা খুললে আমি অড্রে হেপবার্ন।

কাস্টমসের ছেলেটা মামার এক সহকর্মীর ছেলে। মামী আমার পড়ার টেবিলে সারাদিন বলতে লাগলেন,

: ছেলের অনেক উপরি। তোকে সব প্রসাধন কিনে দিতে পারবে। এই যে তমুক নায়িকা, আরে কি জানি নাম, ও তো পাতিলের তলা। শুধু বিদেশী মেকাপের কারণেই তো ও এখন পরী। কাস্টমসের লোকেরা প্রতিদিন বেতন পায়। তোর ছেলেমেয়েরা ও লেভেল, এ লেভেল করে পরে কানাডা আমেরিকা পড়বে। তোর বাপের মতো মাস্টারি করতে হবে না ..

আমি সানন্দার পাতা ওল্টাই অনেক রাতে, সবাই ঘুমিয়ে গেলে। কী যে সুন্দর রাজকন্যাদের মতো মডেল। ছবির পাতা থেকে মেয়েগুলো উঠে এসে আমার হাত ধরে। আমি মালিবাগে ভাসতে থাকি । মনে হয়ে আমার চারপাশে বোগেনভেলিয়ার গাছগুলোতে কে যেন পেইন্ট করছে। কাস্টমসের ছেলেটার হাতে রঙ তুলি। আমি রেণু রেণু লজ্জা পাই।

অনেক রাতে ছেলেটার টেক্সট আসে আমার মোবাইলে। উদ্বেলিত আমি চোখ বড় বড় করে পড়তে থাকি :

: হ্যালো অড্রে হেপবার্ন !

আমার কাল টিউটোরিয়াল জমা দেবার কথা। সব এলোমেলো লাগে। ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে গান ধরি। তখনই হু হু মন ভালো হতে শুরু করে। টেবিলে জমে থাকা সানন্দাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেই বাইরে।

মনে হচ্ছে আমি থবধবে সাদা লংড্রেস পরে রোমান হলিডে ছবির স্যুটিং করছি । গ্রেগরি পেক আমার কোমর ধরে আছে। নাচছি সুরে ।

সর্বনাশ কাস্টমসের ছেলেটা দেখি অবিকল গ্রেগরি পেক।

শেয়ার করুন: