সোভিয়েত নারীর দেশে-১

59267_493165281123_6290323_nসুপ্রীতি ধর: সময়টা ছিল ১৯৮৬ সাল। মাসের হিসাবে অক্টোবর। ৬ অক্টোবর।  তিনদিন আগেই (৩রা অক্টোবর) পার করেছি আমার সাদামাটা এক জন্মদিন, উনিশে পা দেয়া সেই আমি গুলবাগ থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মে-ফেয়ারে এসে স্টেপ-কাট চুল কেটে তা দোলাতে দোলাতে উড়াল দিলাম এরোফ্লোটে করে।

দিনটি এখনও জ্বলজ্বলে আমার স্মৃতিতে। বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় জানাতে আসা মায়ের মুখটা এখনও মনে পড়ে। মনটা কি বিষন্ন ছিল? একদিকে মেয়ের বিদেশযাত্রা, নিরাপদ উচ্চশিক্ষা, অন্যদিকে কোলঝাড়া করে বিদায় দেয়া। মায়ের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছিল, এমন হতচ্ছারা পাজি-জেদি মেয়েটা কী করে যে থাকবে! আর দাদার শ্বশুর রণেশ মৈত্র আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, বিদেশে খাওয়ার সময় বাছবিচার করবে না, চোখ বন্ধ করে খেয়ে নেবে। যদিও পারিনি এই কথা রাখতে, কিন্তু প্রায় অনেক কিছুই খেয়েছি এই জীবনে। সেকথা আরেকদিন হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল আসলে বেশ আগেই। সেই ছোটবেলা থেকেই রাদুগা আর প্রগতি প্রকাশনির সাথে পরিচয়। রং-বেরংয়ের ছড়ার বই, কাশতানকা, মালাকাইটের ঝাঁপিসহ নানান গল্পের বই আর কিশোর বাংলা পত্রিকার পাতায় বুঁদ হয়ে থাকা আমার ছোট্ট জীবনের রূপটাই ছিল অসাধারণ। সোভিয়েত নারীর ছবিগুলো আমাকে মনে মনে কখন যে নিয়ে যেত স্বপ্নের দেশটিতে, কতদিন, কত বছর আমি স্বপ্নই দেখে গেছি। ভাবিনি কখনও সেই স্বপ্ন আমার সফল হবে। মফস্বলের গণ্ডি পেরিয়ে স্বপ্নগুলো এগোতে পারতো না বেশিদূর। বিদেশ তো আরও অনেক দূরের পথ।

১৯৮৩ সালে আমি মফস্বলের মেয়ে এসএসসিতে ভাল ফলাফল (স্ট্যান্ড করেছিলাম বোর্ডে) করে ঢাকায় আসি। ভর্তি হই তখনকার আমলের অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলিক্রস কলেজে। আমার ইমিডিয়েট অথচ ১০ বছরের বড় পিঠাপিঠি ভাই তখন মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির অপেক্ষায়, কাজ করে বাংলাদেশ টুডে নামের একটি পত্রিকায়। সেই আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসে পড়াতে। দুই ভাইবোনের পেয়িং গেস্ট হিসেবে নতুন জীবন শুরু হয় তখনকার কমিউনিস্ট নেতা নূহ উল আলম লেনিন আর রাকা আপার বাসায়।

আসলে নামেই গেস্ট, লেনিন ভাই আর রাকা আপা দ্রুতই হয়ে যান মায়ের পেটের ভাইবোন। সেই বাড়িতেই আমার পরিচয় ঘটে আন্না কারেনিনার সাথে। স্কুলে পড়ার সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন যেমন আমার মনে রেখাপাত করেছিল, আমি সুভাষ বলছি থেকে শুরু করে দেশবিভাগের আন্দোলনের সাথে আমার একাত্মতা গড়ে তুলেছিল আরও অনেক সাহিত্য, তেমনি শরৎচন্দ্র, নীহাররঞ্জন, বিমল মিত্র, শংকর, আশাপূর্ণা, মাঝে মাঝে মাসুদ রানাও ছিল আমার পাঠ্যবইয়ের বিকল্প। আর কলেজে উঠে সেখানে স্থান করে নেয় শীর্ষেন্দু, সুনীল, রুশ সাহিত্য, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বই, পড়ি আর গোগ্রাসে গিলি সব।

রাকা আপা-লেনিন ভাই এরই মাঝে মস্কো যান। তাদের এই সফরের কারণে ভিউকার্ডে দেখা দেশটি আমাকে আস্তে আস্তে আরও কাছে নিয়ে আসতে থাকে। ভিউকার্ডসহ পোস্ট কার্ড তখন আমার প্রতিদিনের জীবনে ভিন্ন প্রলেপ এনে দেয়। আমি স্বপ্ন দেখি, একা একা হেঁটে বেড়াই লেনিনগ্রাদের নেভস্কি প্রসপেক্টে, খুঁজে ফিরি আন্নাকে। শীতের মহোৎসবও আমাকে কাছেই টানে, সেপ্টেম্বরের বর্ণিল সব পাতার ছবি দেখি, তারপর পাতা ঝরে যাওয়া গাছগুলোকে একা ঠায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখে একাকি অনুভব করি মনে, শীতে সেই গাছগুলোও আবার আপন করে বরণ করে নেয় জমাট বাধা বরফকে, শীতের শেষে বরফ গলে পানি হয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট, নদীনালা, এসবই আমার স্বপ্নে ভিড় করে থাকে।

এভাবেই চলতে চলতে একসময় শেষ হয় কলেজ জীবন। এবার বড় পরিসরে যাওয়ার পালা। দেশে তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। আমার দাদা আমাকে এখানে নিয়ে যায়, ওখানে নিয়ে যায়, পরিচয় করিয়ে দেয় জীবনের বিশালতার সাথে। এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার পরই একদিন নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসে ছাত্র ইউনিয়নের মিটিঙে। সেই থেকে আরেকটা পথ আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করে চোখের সামনে। যোগ দিই একটা আবৃত্তি সংগঠনে। সেখানেও সব জ্বালাময়ী কবিতা রক্তে নাচন তোলে। দেশের ভিতরে ঘুরি আবৃত্তি সংগঠনটির সাথে, কোথাও বাধা নেই, বড় হচ্ছি, তাই পরিবারও খুলে দেয় আমার ভবিষ্যতের আগল। আষ্টেপৃষ্ঠে বাধে না। শুধু মায়ের চিন্তা বাড়ে সন্ধ্যা গড়ালে। এতোসব বলার কারণ একটাই, নতুন একটা জীবনের ভিত এভাবেই গড়ে উঠেছিল আমার মনে।

এসময়ই একদিন দাদা জানতে চায় আমি রাশিয়ায় পড়তে যেতে চাই কিনা! আকাশ থেকে পড়ি, চাই না মানে? কিন্তু সাথেসাথেই বুকটা চিনচিন করে উঠে মায়ের জন্য, একা তো কোনদিন থাকিনি কোথাও। অবশ্য ধোপে টেকে না আমার এই ন্যাকামো। কাগজপত্র আসে বাসায়, ফিলআপ করি, সাইন করি। বুঝতে পারি, আমার স্বপ্ন তখন ধরা দিতে শুরু করেছে। (চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.