লীনা হক: আজ থেকে আরেকটি নুতন বাংলা বছর এসে গেল। প্রায়ই ভাবি কিভাবে কিভাবে সময়ের সাথে সাথে উৎসবের চেহারা বদলে যায়। ছেলেবেলায় বাংলা নববর্ষ পালন বলতে বুঝতাম মূলত ব্যবসায়ের হালখাতা উদযাপন, মিষ্টি খাওয়ানো। বরং চৈত্র সংক্রান্তি ছিল নুতন বছরের উৎসবের অনেকখানি জুড়ে। কিশোর বেলায় আমাদের কাছে পহেলা বৈশাখের চাইতে ব্রহ্মপুত্র তীরের চৈত্র সংক্রান্তির মেলা আর চড়ক পূজার আকর্ষণ ছিল দারুণ। পিঠে বড়শি বিঁধিয়ে চড়কের সেই ঘূর্ণি মনের মধ্যে ভয় মিশ্রিত রোমাঞ্চকর অনুভূতি।
বিক্রি হতো মুড়কি, চিনির সাজ- চিনি দিয়ে তৈরি ছোট ছোট হাতি- ঘোড়া পুতুল, দুধ সাদা কদমা,গজা, বাতাসা, তিলের তক্তি, ঝাল মিষ্টি মুরলী, বিন্নি ধানের খই এই সব। নাগর দোলায় চড়ে দুলুনীতে চিল চিৎকার আর আমার ছোটবোনের ভয়ে কান্নাকাটি। মুড়ি কদমা নাগরদোলা সবই আছে এখনো। এমনকি ঢাকা শহরের বৈশাখী মেলাতেও পাওয়া যায় সব। শুধু আমার অনুভবটা বদলে গেছে!
আমার শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে নানীর কাছে গ্রামের বাড়িতে। মনে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তিকে সামনে রেখে সবার বাড়িঘর পরিষ্কার করা হতো। বিছানা বালিশ রোদে দেয়া, ঘরবাড়ির আনাচে-কানাচে পরিষ্কার করা হত। আমাদের ময়মনসিংহের বাড়ির বাইরের মাঠের ঘাস আগাছা, ভিতরের পুকুরের কচুরিপানা পরিষ্কার করার সময় আমরাও বিপুল উদ্যমে হাত লাগাতাম। মনে পড়ে আমাদের ওয়ার্ডের কমিশনার আফাজ কাকু নববর্ষের আগে পাড়ার রাস্তা ড্রেন পরিষ্কার করাতেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা কাজ শেষে সব বাড়ী থেকে বখশিশ পেতেন। চৈত্র সংক্রান্তির আগে আগে শীতের লেপ কাঁথা পুরনো শাড়ী দিয়ে পেঁচিয়ে দাদীর কাঠের সিন্দুকের ভিতর কালো জিরা আর নিম পাতা দিয়ে রাখা হতো যাতে পোকায় না কাটে। মা ন্যাপথলিন ব্যবহার করলেও দাদি নিম পাতা আর কালো জিরার পুটলি রাখতেন বাক্সের ভিতরে। আরও স্মৃতিতে ভাসে নানীবুজির তদারকিতে ঘর উঠোন লেপা, এমনকি বাঁশের তৈরি বড় বড় ধান চাল রাখার ‘ডোল’ গুলোকেও মাটি আর ধানের চালের কুঁড়া দিয়ে মাটি মিশিয়ে লেপা হতো- বৎসরের আবর্জনা দূর করতে। নানীর বাড়ীতে লেপগুলোকে মুড়িয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘরের চালের কড়ি বরগার সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। আসলেই বর্ষ বরণের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকতো গ্রামীন জীবন।
চৈত্রের শেষ দিনে নিম পাতা ভাজাসহ নিরামিষ খাওয়া এসবের প্রচলন ছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে। এখনো মনে পড়ে, খালাতো ভাই আরিফ (আমরা দুজনেই বেশ কিছু বছর নির্বাসিত ছিলাম নানীর কাছে!) পাতের পাশে গুড় রাখত যাতে নিয়ম রক্ষার নিমতিতা মুখে দিয়েই গুড় খেতে পারে! আমাদের ময়মনসিংহ শহরের চৈত্র সংক্রান্তির মেলা ছিল বিখ্যাত। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের সেই মেলায় কি না পাওয়া যেত। কাঠের তৈরি ডালের ঘুঁটনি, রুটি বেলার বেলন পিঁড়ি, পিঁড়ি, ছোট জলচৌকি থেকে শুরু করে চেয়ার-টেবিল-আলনা সব পাওয়া যেত। পিঠা তৈরির ছাঁচ,বটি, নারকেল কুরুনী, মাটির কলসী, চিনি,লবন আর আচার সংরক্ষণ করার চীনা মাটির বয়াম- ঢাকনা সহ নানা সাইজের বয়াম। বেতের কুলা, বিভিন্ন সাইজের ডালা- ধান রাখার জন্য থেকে শুরু করে মুড়ি খাওয়ার জন্য সব পাওয়া যেত সেই মেলায়। ছোট সাইজের ডালা গুলোকে ‘কাঠা’ বলতাম আমরা। মা কাকীরা সংসারের এই সব অতি প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিস এই একটি মেলা থেকে কেনার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন।
নুতন জামা কাপড়ের এত চল ছিল না, সত্যি বলতে কি বৈশাখ উপলক্ষে কোন নুতন জামা পেয়েছি কখনো- মনে করতে পারি না। আমাদের বন্ধুরাও কেউ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নুতন পোশাক পেয়েছে বলে স্মৃতিতে নাই। ছিল না কোন ইলিশ পান্তা খাওয়ার উৎসব। পহেলা বৈশাখের দিন বাড়ীতে মা একটু ভাল মন্দ রাঁধতেন। বড়রা খেতেন সাত রকম শাক আর আমাদের পাতে পড়তো মাংস। তবে মূল ছিল মিষ্টি খাওয়া। তবে পহেলা বৈশাখের সকালের নাশতা থাকতো দই চিড়া গুড় আর কলা। সাগর কলা নয়, সবরি অথবা চাঁপা কলা। বাতাসাও দিতেন নানী। দাদী তৈরি করতেন আম পোড়া শরবত – কাঁচা আম পুড়িয়ে গুড় আর কাঁচা মরিচ দিয়ে তৈরি হতো সেটা। নিজেদেরই তো আমগাছ ছিল কত। গুড় আর ছাতুর শরবত করতেন নানী। মা পহেলা বৈশাখের দিন বাড়ীর কাজে সহায়তা করত যারা, তাদের জন্য মিষ্টি কিনে দিতেন।
আমার ছোট বেলায়, কাগজের বাক্স নয়, মাটির ছোট হাঁড়ি আর বেতের কাঠির তিনকোনা ফ্রেমে শালপাতার ঠোঙ্গায় মিষ্টি বিক্রি হত। বেশীর ভাগ মিষ্টিই ছিল রসের। শালপাতার ঠোঙ্গা গড়ানো মিষ্টির রস চেটে খেতে গিয়ে ছোট ভাই পিটুনি খেয়েছিল মায়ের হাতে। কৈশোরে বৈশাখের আরও একটি আকর্ষণ ছিল স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মনে পড়ে, কোন এক বৈশাখে স্কুলে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। বেবী করেছিল ‘চিত্রাঙ্গদা’ আর ‘উত্তীয়’ সেজেছিল কে যে- পার্ল বোধ হয়, আর আমি ছিলাম মৃত সৈনিকের ভূমিকায়। একবার আমরা মঞ্চস্থ করেছিলাম ‘ মায়ার খেলা’। ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না শুধু সুখ চলে যায়- একি মায়ার ছলনা! মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চাইতে রিহার্সালের সময়গুলো ছিল উত্তেজনায় ভরপুর।
প্রতি বৈশাখে দেয়াল পত্রিকা বের হত স্কুলে- দেয়ালিকা বলা হত। আমাদের স্কুলের শেষ বছরের দেয়ালিকায় আমার একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল যা নিয়ে বন্ধুরা হাসাহাসি করেছিল যে ওটা নাকি ‘গবিতা’ হয়েছে, কিন্তু দেয়ালিকার দায়িত্বপ্রাপ্ত লাইব্রেরী শিক্ষক জামান স্যার মায়া করে ছেপে দিয়েছেন। আমার হাতের লেখা ভাল হওয়াতে নববর্ষের দেয়ালিকার কপি রাইটার হিসাবে নাম করেছিলাম স্কুল জীবনে! কলেজ জীবন পর্যন্ত আমার জীবনে মফস্বল শহরের বর্ষ বরণই ছিল নানাবিধ প্রস্তুতিসহ আনন্দ। ক্রমে ক্রমে বর্ষ বরণ আমার জন্য সন্তানদের আনন্দ উদযাপনে আর এখন তো টিভিতে বর্ষ বরণের অনুষ্ঠান দেখায় স্থিতি লাভ করেছে।
এখন যে পরিসরে আর যেভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করি আমরা,তার কোন কিছুই আমাদের ছেলেবেলায় ছিল না। কোন আলোচনা-সমালোচনায় না যেয়েই বলতে পারি এখনকার উৎসব অনেক বেশী পোশাকি। এটা অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত মত। তবে তখন যেমন আনন্দ ছিল, এখনো অনেক আনন্দের এই নববর্ষ উদযাপন। এই যে এক বিশাল আনন্দ নববর্ষ উদযাপনের জন্য, তার রেশ অবশ্যই সবাইকেই ছুঁয়ে যায়। অবশ্য কাউকে কাউকে হয়তো কেটেও যায়- নুতন পোশাক আর হাজার হাজার টাকা দিয়ে ইলিশ খাওয়ার আনন্দের এই বচ্ছরকার দিন। আমার কন্যা ব্যস্ত তার পহেলা বৈশাখের সাজ পোশাক ইত্যাদি নিয়ে। তার আনন্দ দেখে মনটা ভরে যায়। হোক না হয় একটু পোশাকি, তবু ও এইযে গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে মেয়ে তার বন্ধুদের সাথে পরিকল্পনা করছে বৈশাখের প্রথম দিন উদযাপনের জন্য, তার রেশ আমাকেও আলোড়িত করে। সেইসাথে মনের কোনায় একটু বেদনাবোধ মাধবীলতার সুবাস ঘেরা আমার কৈশোরের সেই নববর্ষের জন্য।
বাংলা নব বর্ষের শুভেচ্ছা জানাই সবাইকে। …যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি অশ্রুবাস্প সুদূরে মিলাক… মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা। সবাই সুখে থাকুক, সবাই আনন্দে থাকুক। জগতের এই আনন্দযজ্ঞে সকলের সমান অংশগ্রহণ থাকুক। জগতের সকল মানুষের সুখী হবার অধিকার কোন হানাহানি, কোন ভেদাভেদ, কোন দারিদ্র্য যেন হরণ করতে না পারে।