ঘরের ভেতরে নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশের মেয়েরা

bd_women_violence
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রচারণা

ফারহানা পারভীন: রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বস্তিতে থাকেন মনি বেগম। একটি ঘর ভাড়া নিয়ে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে তার সংসার। আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে কাজ করেন মনি। কিন্তু গত কয়েক দিন হল তাকে কাজে যেতে দেখা যায়নি। বাড়িতেও তিনি একা। মনির সাথে যখন কথা হল তখনও তার চোখের নিচে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন। তিনি বলছিলেন, দিন চারেক আগে তুচ্ছ এক কারণে স্বামী তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়।তবে এটা নতুন নয়। বিয়ের পর থেকেই ছোট ছোট কারণে স্বামী তাকে শারীরিক নির্যাতন করে আসছে। সাথে শাশুড়ি আর দেবরও।

আরেকজন মেয়ের সাথে কথা হলো, যার ১১ বছর আগে বিয়ে হয়েছে। একটি ছেলে তার। মেয়েটির কথা অনুযায়ী তার স্বামী অন্য একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কারণেই এক পর্যায়ে তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরে। এরপর তার ওপর চলে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন।

মেয়েটি বলছিলেন, সব কিছুর পরেও মানসিক নির্যাতনটাই তার কাছে অসহনীয় হয়ে পড়ে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তাই তিনি চলে আসেন বাবার বাড়িতে। মেয়েটি একটি স্কুলে চাকরি করেন। তার স্বামীর আপত্তি সেই চাকরিতেও। মেয়েটির স্বামী এখন তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে তার ছেলেকে তার কাছ থেকে নিয়ে যাবে বলে।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সরকারি জরিপ

সমাজে নারী নির্যাতনের এধরনের চিত্র নতুন নয়। শহর, গ্রাম, নিম্নবিত্ত, উচ্চবিত্ত,স্বল্প শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত সব স্তরের ঘটছে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা। নির্যাতন হচ্ছে কখনো শারীরিক, কখনো মানসিক, কখনো আর্থিক আবার কখনো যৌন হয়রানির শিকার।

সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সরকারি এক জরিপে বলা হচ্ছে দেশের বিবাহিত মেয়েদের ৮৭ শতাংশ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নিজের ঘরে স্বামীর দ্বারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর করা এই জরিপে দেখা যাচ্ছে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী স্বামীগৃহে মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

কেন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মেয়েরা?

বাড়ীতে মেয়েদের এই নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণ কি? আমি কথা বলেছিলাম কয়েকজন পুরুষের সাথে।

তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলছিলেন বিয়ের পর মেয়েরা তার স্বামীর বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের ঠিক আপন করে নিতে পারেন না, যেটা তাদের কাছে বড় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শাহেদ নামের একজন বলছিলেন, “আমার স্ত্রী চাকরি করবে এটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়”। আবার অনেকেই বলছিলেন মেয়েদের চাকরি করতে চাওয়াটা তাদের পছন্দ নয়।

আবার কেউ কেউ এক্ষেত্রে দুজনের মতের অমিল হওয়া এবং মেয়েদের পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে না পারাটাও পুরুষের অপছন্দের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। মেয়েদের ওপর এই নির্যাতন প্রতিরোধ করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও থেমে নেই এই নির্যাতন।

নারী বিষয়ক গবেষণাধর্মী সংগঠন উইমেন ফর উইমেনের নির্বাহী সদস্য সালমা খান বলছিলেন, তাদের দীর্ঘ দিনের গবেষণায় মেয়েদের নির্যাতিত হওয়ার পিছনে মূলত পুরুষের সমাজ নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতাকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখেছেন।

গবেষণায় এবং অন্যান্য সূত্র থেকে নারী নির্যাতনের যেসব কারণ এবং নির্যাতনের যে হার লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে এখনকার মেয়েরা বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?

বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত কয়েকজন মেয়ের সাথে কথা বলে জানা গেল, তারা নারী নির্যাতনের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে তারা আতঙ্কিত।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সোমা বোস। তিনি বলছিলেন, ‘আমার বিয়ে হলে আমার স্বামী কি আমার এই চাকরি করা মেনে নেবে?’ তিনি বললেন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছেন। বাবা-মা বিয়ের কথা বললেও তিনি ভয় পাচ্ছেন সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা নিয়ে।

নন্দিতা দেবী মাত্র পড়াশোনা শেষ করেছেন। তিনি বলছিলেন, নারী নির্যাতনের অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে প্রমাণিত হলে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

আইনের সহায়তা নিচ্ছেন কি?

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশে রয়েছে কঠোর আইন। সেখানে নারী নির্যাতনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু নির্যাতনের শিকার এসব মেয়ে আইনের দ্বারস্থ হন কতটা? বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নীনা গোস্বামী বলছিলেন, আগে মেয়েরা গৃহে নির্যাতনের বিষয়টিকে আমলে নিতেন না। ‘এখন শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে মেয়েরা আগের থেকে কিছুটা আইনের সহায়তা নিচ্ছে”।

তারা ধরেই নিয়েছিলেন স্বামীর দ্বারা তারা নির্যাতিত হবেন এটাই স্বাভাবিক।

ফিরে যাই মনি বেগমের কথায়। তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তিনি জানেন না, কিভাবে তার স্বামী, দেবর ও শাশুড়ির দ্বারা নির্যাতনের বিষয়ে আইনি সহায়তা পেতে পারেন। আবার সেই মেয়েটি- যিনি উচ্চ শিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী, তিনি জানেন কিভাবে আইনের আশ্রয় নিতে হয়। তারপরেও তারা দুজনেই শিকার হয়েছেন নির্যাতনের।

বাংলাদেশে এই নির্যাতনের মাত্রা আগের থেকে বেড়েছে না কমেছে, নাকি মেয়েরা নির্যাতিত হওয়ার পর আগের থেকে বেশি কথা বলছেন সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে- যে দ্রুত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে- সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.