রোজ নামচা-১৪

Black womenউইমেন চ্যাপ্টার: বাংলাদেশের দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী আজ চৈত্র সংক্রান্তি, কাল পহেলা বৈশাখ। গতকাল জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার পেয়েছি বাসার নিচের মুদি দোকানদার হোসেন ভাইয়ের (পুরো নাম জানি না) কাছ থেকে। উনি কাঁচা আম পাঠিয়েছেন নববর্ষের উপহার হিসেবে। সো-কলড নিকটজনেরা যখন কেনাকাটার হাত গুটিয়ে বসে থাকে আমাকে কিছু দেয়ার বেলায়, তখন একজন দোকানদারের কাছ থেকে পাওয়া এই উপহার আমার কাছে অনেক দামী। হোক না তা আম, এখানে দেয়াটাতে যে আন্তরিকতা আছে, তার মূল্য আসলেই অনেক।

এই হোসেন ভাই আমার কাছে একজন আনসাং হিরো, শাহবাগ আন্দোলনের শুরু থেকেই মনে-প্রাণে আমাদের সাথে ছিলেন, এখন নেই। কেন নেই, সেই বিতর্কে নাইবা গেলাম। না, উনার কোন পদ ছিল না, বা মাথায় কোন হলুদ রংয়ের ফেট্টিও ছিল না, তবে চাওয়া-পাওয়া ছিল। সেখানে গরমিল দেখা দেয়ায় উনি কিছুটা সরে এসেছেন। কিন্তু প্রথমদিকে উনি প্রায়ই দোকান ফেলে মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ যেতেন। রাতে বাসায় ফিরতি পথে দোকানে নামতেই বলতেন, ‘আপনারে দেখছি দিদি’, রাজীবের জানাজায় তিনিও শরীক হয়েছিলেন। বাসার আশপাশে তখন অপরিচিত লোকের আনাগোনা দেখে তিনি সতর্ক হয়ে যেতেন, গোপনে আমাকে জানিয়ে দিতেন, ‘দিদি কি বাসায়?’ বাসায় না থাকলে তাঁর উপদেশ হতো, ‘এখন আইসেন না’, বা বাসায় থাকলে বলতেন, ‘এখন নাইমেন না’। শুনেছি আশেপাশের বাসার অনেকেই নাকি তখন উৎসুক হয়ে শাহবাগে কারা যায়, তা জানতে চাইতো। হোসেন ভাই স্বভাবসুলভ হাসি দিয়েই উড়িয়ে দিতেন সেইসব কৌতূহল। কিন্তু আড়ালে আমাকে বলতেন, ‘দিদি, একটু সাবধানে চইলেন’।

পাকিস্তান দুতাবাস ঘেরাওয়ের সময় যখন পুলিশ মারলো, তখনও এই হোসেন ভাই আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি সেখানে গেছি কিনা! যাইনি শুনে নিশ্চিন্ত হলেন। এমনটি হয়েছে শাহবাগে হেফাজতে ইসলামের হামলার সময়ও। ফোন ধরতে পারছিলাম না সেই সময়ের উত্তেজনায়। কিন্তু বিরতিহীনভাবে ফোন করে আমাকে ধরেই ছাড়লেন হোসেন ভাই। জানতে চাইলেন অক্ষত আছি কিনা! এই সেদিনও যখন শাহবাগে মারামারি হলো, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন তিনি। অথচ অবাক হয়ে ভাবি যে, এতোগুলো ঘটনার সময় আমার রক্তীয়দের কেউ আমার খোঁজটি পর্যন্ত নেয়নি। নিয়েছে যারা তারা অবশ্যই তাহলে আমার আত্মীয়।

এই হোসেন ভাই রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পরও জানাজায় গিয়েছিলেন। এসে গল্প করেছিলেন, ‘মানুষের মাথা মানুষে খায়, এমন ভিড়’। উনি অবাক হয়ে দেখেছিলেন, একজন রাষ্ট্রপতির প্রতি মানুষের কতো ভালবাসা। বিরোধী দল থেকে শুরু করে কে ছিল না সেই শেষযাত্রায়! হোসেন ভাই অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন। দেশে কখন, কী হচ্ছে, সব জানতে চাওয়া চাই। অবাক হয়ে যাই, তার এই সচেতন জ্ঞান দেখে। ভাবি এমন যদি হতো আমাদের চালকেরা, কত সুখেই না দিন কাটাতাম আমরা। বাসায় চৈত্র-বৈশাখে জলের সমস্যা হলে আমাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি দু:শ্চিন্তায় পড়েন এই হোসেন ভাই। ফোন করে জানিয়ে দেন, যেন আমি আগে থেকেই প্রস্তুত থাকি।

আমার একান্ত আপন আরেকজন হলেন আমারই ডান হাত ‘খালা’, যাকে ছাড়া আমি ভাবতেই পারি না আমার জীবন। তিনি আবার এলাকায় ‘সানির মা’ বলেই পরিচিত। দুই বেলা আসেন আমার বাসায়, সময়ে-অসময়ে আসেন। ছয়তলা বেয়ে উঠাতেও উনার কোন আলস্য নেই। আমার বাসার দারোয়ান ভাই তাকে ‘তক্তা মহিলা’ (আয়রন লেডিই হবে হয়তো) উপাধি দিয়েছেন দৌড়ের ওপর কাজ করেন বলে। সেই খালার মৃদু বকুনিও আমি বেশ উপভোগ করি। বিশেষ করে আমি বাসার বাইরে থাকলে উনার মাথা চড়া থাকে। পই পই করে বলে দেন, যেন সময়মতো ফিরি বাসায়। অসুস্থ থাকলে বার বার আসেন, অন্য বাসার কাজ ফেলে হলেও ছুটে আসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ইস্ মাথাটা কত্ত গরম, আর মাথাডারই বা দুষ কী, যা যায় এইডার উরফে দিয়া’। বেশ মজা পাই খালার এই ভালবাসা দেখে। হোসেন ভাইয়ের দোকানে আমাকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। খালা এসে সব আমাকে বলেন। ‘আইজ হোসেইন্যা আফনেরে লইয়া এই কথা কইছে’ বলেই হাসিতে ভেঙে পড়েন আমার ঋজুদেহি খালা। হিসাব করে দেখেছি, খালা আমার বয়সীই হবেন, উনার ভাষায়, সংগ্রামের সময় কোলে ছিলেন মায়ের। একই বয়সী না হলেও স্পষ্টই বোঝা যায়, কাছাকাছি বয়সেরই হবে। তিনি বলে চলেন, আমার বাসায় কি পরিমাণ সাবান লাগে, টিস্যু লাগে সব জানে আশপাশের মানুষ। আমি ভাবি, এটাও তাহলে আলোচ্য বিষয়!

এতো কথা বলার কারণ হলো, আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, আমার এই মূল্যহীন জীবনে এই হোসেন ভাই, খালা, খালার স্বামী (আরেক বাসার দারোয়ান) এরাই অনেক আপন। ফোন করলে কি সুন্দর করে খালার স্বামী আমাকে বলেন, কি খালা, কিছু লাগবো? আফনের খালারে ফাডাইয়া দিতাম??? মনটা ভরে যায় ভাল লাগায়। আসলেই তো, যতোই আমি একা একা বলে নিজেকে জাহির করি না কেন, আসলে তো একা নই। এই মানুষগুলোর নজরদারিতে ভালই কেটে যাচ্ছে সব।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.