বুলিইং-সমাজের আরেক ক্ষত

eve teasing 2তানিয়া মোর্শেদ: দু’দিন আগে দীপ্ত (আমার ছেলে) স্কুল থেকে ফিরে বললো যে, এক স্টুডেন্ট (সিক্সথ গ্রেইডের) মারা গেছে। আমার প্রথমেই মনে হলো যে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে হয়ত।
কিছুক্ষণ পর দীপ্ত বললো যে, স্কুলে অনেকেই বলছিল যে, সুইসাইড মনে হয়!
আমি বললাম যে, না জেনে কিছু বলতে হয় না। সন্ধ্যার মধ্যেই বললো যে, অনেকেই বলছে (ই-মেইল দেখে) যে সুইসাইড। কারণ হিসাবে বলছে, বুলিইং।
এদেশ সহ অনেক দেশেই কিশোর বয়সে বুলিইং-এর শিকার হয়ে অনেকেই আত্মহত্যা করে। এটা ভীষণ চিন্তার বিষয় সব অভিভাবকদের জন্যই। এবয়সে শারীরিক-মানসিক ভাবে অনেক পরিবর্তন আসে, সে অবস্থায় বুলিইং অনেকেই সহ্য করতে পারে না, আত্মহত্যা বেছে নেয়। এর শিকারের বয়স কমতে কমতে কততে পৌঁছেছে তা জানি না। তবে অনেক অল্প বয়সী আত্মহত্যা করছে এটুকু খবরে পাই।
বাংলাদেশে বুলিইং-কে এখনো সেভাবে দেখা, ভাবা, সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে কিছু করা হয় কিনা জানি না। তবে ধারণা করতে পারি, এখনো সেভাবে কিছু করা, ভাবা হয় না। বুলিইং-কে “খ্যাপানো”,  “অমন সবাই করে” এভাবেই হয়ত দেখা হয় এখনো। বুলিইং শুধু শারীরিকভাবেই হয় না। কথা, আচরণ দিয়েও হতে পারে। আছে সাইবার বুলিইং। এ’যুগে সাইবার বুলিইং সাংঘাতিকভাবে হয়, হতে পারে।

বৎসর দুয়েক আগে ইস্ট কোস্টের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক স্টুডেন্ট আত্মহত্যা করেছিল। ডর্ম রুমমেইটের সাইবার বুলিইং-এর শিকার হয়ে। ছেলেটি ছিল গে। তার রুমমেইট (ইন্ডিয়ান অ্যামেরিকান, রেইস বলবার কারণ একটু পরে বোঝা যাবে। কারণ ছাড়া কারো রেইস বা এধরনের কিছু বলি না) ছেলেটির কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্ত ভিডিও করে অন লাইনে পোস্ট করেছিল। এক চাইনিজ মেয়ে স্টুডেন্ট (এখানেও কারণ আছে রেইস বলবার জন্য) আর সে মিলে ছেলেটিকে হেয় করবার জন্য করেছিল। ছেলেটি ব্রিজের উপর থেকে লাফ দিয়েছিল।

খবরটি বেশ কিছু দিন ধরে আলোড়ন তুলেছিল দেশে। না শুধু বুলিইং-এর জন্যই নয়। যখন কেইসটি কোর্টে যাবে যাবে (বিচার শুরু হবার আগেই) ইন্ডিয়ানদের বেশ বড় গ্রুপ প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদে নেমেছিল। কি কারণে? তারা বলতে চাইছিল যে, ছেলেটিকে যেন শাস্তি না দেওয়া হয়। তার বাবা-মা রীতিমত মিডিয়াকে তিরস্কার পর্যন্ত করছিলেন! তাদের সন্তান কত ভালো ইত্যাদি বলছিলেন।

ইন্ডিয়ানদের সাথে বাংলাদেশীরাও হয়ত যোগ দিয়েছিলেন! বলবার কারণ আছে। ব্যক্তিগত ভাবে দু’জনের সাথে আমার এ বিষয়ে বাদানুবাদ হয়েছে। আমার প্রশ্ন ছিলা যে, কেন তারা প্রতিবাদ করছেন? জাজ তো কিছুই বলেননি, করেননি তাহলে আগেই কেন ধরে নেবো যে, বর্ণ বৈষম্য হতে পারে? এদেশে আমার জানা মতে বর্ণ বৈষম্য অন্য যে কোনো পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকে অনেক কম। দক্ষিণের প্রদেশগুলোতে যতটা আছে উত্তরের প্রদেশগুলোতে অনেক কম। আর বিচার হবার আগেই কিভাবে ধরে নেবো যে বর্ণ বৈষম্য হবে? আমরাও কি তাহলে “প্রিজুডিস” দেখাচ্ছি না? একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ কিভাবে জানবে না যে কারো ব্যক্তিগত বিষয় অনুমতি ছাড়া ভিডিও করা (অনলাইনে দেওয়া তো আরো পরের কথা) অপরাধ? না কি ছেলেটি গে বলে এত সহজেই এত মানুষকে প্ল্যাকার্ড হাতে দেখা গিয়েছিল?? আমি যদি বলি তাই তাহলে আমাকেও অনেকে বলবেন যে, আমি প্রিজুডিস মাইন্ড নিয়ে দেখছি। না আমি কাউকে আগেই বিচার করতে চাই না। কিন্তু অনেক মানুষের আলাপচারিতা থেকে জানি, আমাদের উপমহাদেশের মানুষরা গে, লেসবিয়ান, ক্রস ড্রেসারসহ এধরনের মানুষদের কী চোখে দেখেন!

ডাক্তার মানুষেরও এমন মন্তব্য শুনেছি যে, ভাবতে বাধ্য হয়েছি, ডিগ্রী থাকলেই “শিক্ষিত” হয় না। আমি অনেক কথার পরে এটা বলেছিলাম যে, যদি ভিকটিম ইন্ডিয়ান বা বাংলাদেশী হতো আর অপরাধী “সাদা” হতো তাহলে কি এত মানুষ প্রতিবাদে যেতেন? উত্তর পাইনি। কথা অন্য দিকে ঘুরে গেছে। সব ব্যাপারেই আমাদের অনেক আস্থা এদেশের সিস্টেমে। কিন্তু নিজেদের কেউ (এক রেইস, দেশ, আর ধর্ম হলে তো কথাই নেই (বিশেষত মুসলমানদের মধ্যে)) অপরাধ করলে, ভুল করলেও আমরা “বর্ণ বৈষম্য” খুঁজি। এই আমরাই কিন্তু অন্যদের (অন্য রেইস, দেশ, ধর্ম) বর্ণ বৈষম্য সত্যিকার ভাবে ঘটলেও চুপ থাকি!

দীপ্তকে কিছু বাংলাদেশী পরিবারের মেয়ে (কারণ আছে বলেই লিখছি) বেশ লম্বা সময় ধরে বুলিইং করছিল, আজ থেকে কিছু বৎসর আগে। এমনিতে সেসব পরিবারের সাথে বড় কোনো নিমন্ত্রণ বাদে দেখা হতো না। কিন্তু দেখা হলে দল বেঁধে একটা বিশেষ কিছু বলতো যা ওকে বিরক্ত করতো। বৎসর পার হয়ে যায় তবুও তা বন্ধ হয় না। এর মধ্যে আমি ওকে শিখিয়েছি, কীভাবে বুলিইং মোকাবেলা করতে হয়। আগে থেকেই শিখাচ্ছিলাম। একদিন বুঝলাম সীমা ছাড়ীয়ে গেছে ব্যাপারটা। নিয়মানুযায়ী স্কুলের টিচারকে জানানোর কথা, যেহেতু স্কুলে ঘটেছিল সর্ব শেষ ঘটনাটা। আমি তবুও ভাবলাম যে, কমিউনিটির মানুষ, আগে অভিভাবকদের বলি। তারা বোঝালে যদি বন্ধ হয়।

আমি প্রথম যে মা’কে ফোনে বললাম তিনি আমাকে এক ঘন্টা ঝারলেন। তিনি মানতেই পারেন না তার এত মেধাবী মেয়ে কীভাবে বুলিইং করবে? না আমি বুলিইং শব্দ বলিনি। খুব সহজভাবে বলেছিলাম যে, তারা (মেয়েগুলো) যা করছে, তা দীপ্ত পছন্দ করছে না। এটুকুই। অনেক কথার পর তিনি বলে বসলেন যে, আমার উপর তার রাগ আছে। তাই তিনি আমার ছেলের বিষয়ে তো কথা শুনবেনই না! আমি দেখলাম একজন উচ্চ শিক্ষিত, সমাজে সব দিক দিয়ে “ভাল” নামে পরিচিত (হয়ত) এক মানুষের অন্তরের অন্ধকার!

আমি কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাই না, গসিপ করি না, শুনিও না। তাহলে আমি কী করেছি? আমার স্বভাব হচ্ছে কোনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করা, বলা। এরকম একটি কাজ করেছিলাম যা তার পছন্দ হয়নি! অন্য আরেক মেয়ের মা’কে বলতেই সে বলেছিল যে, বলে খুব ভালো করেছি। ভবিষ্যতেও যদি তার কোনো সন্তানের কিছু ভুল করা দেখি যেন জানাই! যে কারণে রেইস (ইন্ডিয়ান, চাইনিজ লিখলাম), মেয়ে লিখলাম তার কারণ হচ্ছে, আমদের মধ্যে অনেক “মিথ” আছে। আমরা ভাবি বুলিইং শুধু সাদা আর কালোরাই করে। শুধু ছেলেরাই করে ইত্যাদি। না ভাল, খারাপ সব রেইসে থাকে, সব জেন্ডারে থাকতে পারে। এখানে মানুষটির কর্ম দায়ী, অন্য কিছু নয়। সেই ইন্ডিয়ান ছেলেটির সাজা অনেক কম হয়েছে।

Tania Lopa
তানিয়া মোর্শেদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক

আমাদের সবার ভাবা উচিৎ যে, সন্তান শুধু ভালো স্টুডেন্ট হওয়াই সবচেয়ে বড় সার্থকতা নয়। কতটা “মানুষ” হচ্ছে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। আর বুলিইং-এর শিকার হলে কি করতে হবে তা শেখানো, নিজে যেন কাউকে কখনো কোনো ধরণের বুলিইং না করে তা বোঝানো ভীষণ জরুরী। আর আত্মহত্যা কোনো কিছুর সমাধান নয়।

চোখে, মনে মেয়েটির ছবি ভেসে উঠছে গত ক’দিন ধরে। হ্যাঁ সে খুব মেধাবী ছিল, অনেক কিছু করতো। কিন্তু সেও বুলিইং-এর শিকার ছিল, হয়ত (আত্মহত্যা বা বুলিইং নিশ্চিত নই যেহেতু তাই “হয়ত” বলছি)। তার মা-বাবা, পরিবার, বন্ধুর কথা ভাবলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে!
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.