
বিয়ের প্রশ্নে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত পুরুষের মানুষিকতা- তারা গাছেরটা খেতে চায়, আবার তলারটাও কুড়াতে চায়! আরেকটু বিশ্লেষণ করে বললে, তারা বউ হিসেবে এমন মেয়েকেই চায় যারা হবে শিক্ষিত, কর্মজীবী ( অবশ্য পুরুষের চেয়ে বেশি উপার্জনক্ষম নয় এবং চাকরি ছাড়তে বললেই ছেড়ে দিতে প্রস্তুত থাকনে এমন), আধুনিক, প্রগতিশীল। আবার পাশাপাশি তারা এটাও চায় মেয়েটিকে ঘরকন্নার কাজেও তাকে মনোযোগী থাকতে হবে। সুচারুভাবে সামলাতে হবে সংসার। কে এক টুকরো মাছ কম পেলো কিংবা কে একবেলা খেলো না পাই টু পাই খবর রাখতে হবে। নাইলে সে কিসের মেয়ে মানুষ! অফিস করো, কাজ করো ঠিক আছে, কিন্তু রান্নাঘর সামলাতে না পারলে তুমি আবার কিসের মেয়ে মানুষ! এদের চোখে মেয়েমানুষ আর মানুষ হয়ে ওঠেনা।
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও, আবুল হাসানের এই কবিতায় যেন এদেশের নারীদের চূড়ান্ত ভাগ্য! আর যারা এই ভাগ্যকে খণ্ডন করতে চায়, তাদের জীবনে নেমে আসবে অনামিশার অন্ধকার। যখন নারী চিৎকার করে জানান দিবে তার অস্তিত্ব, অন্যের চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিতে চাইবে মানুষ হিসেবে তার অধিকার, তখনই নেমে আসবে পুরুষতন্ত্রের খড়গ। স্বামী, শশুর, শাশুড়ি, সমাজ, রাষ্ট্র কখনো বাবা-মাও ঝাঁপিয়ে পড়বে। ব্যাপারটা এরকম- যদি সংসার করতে চাও নীরবে সহে যাও, নাইলে তোমার কপালে কিছুই জুটবে না!
সম্প্রতি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্যান্ডি টো চীনের অবিবাহিত নারীদের উপর গবেষণা করে বের করেছেন ভয়ানক সত্য দুটি তত্ত্ব। অতি যোগ্য নারীদের বর মেলে না, অন্য ভাবে বলা যায়, নিজেকে যোগ্য করতে বয়স কিছুটা পার হলে পুরুষরা সেই সব নারীদের ভাবেন ‘পরিত্যক্ত হওয়া এড়াতে সংগ্রামরত’। যদি ৩২ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, চীনা পুরুষদের বিবেচনায় তারা ‘কুড়েঘর বাসিনী’ যারা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকায় স্বামী-সংসার নিয়ে ভাবার সময়ই পান না৷ তাদের বিয়ে হওয়াটা আরো কঠিন৷ আর বয়স ৩৫ বছরের বেশি হলে মেয়ে যত যোগ্য, যত সুন্দরীই হোক, চীনের বিয়ের বাজারে তারা অপাঙক্তেয়!
চীনের পুরুষরা তাদের চেয়ে যোগ্য মেয়েদের বিয়ে করতে অনিচ্ছুক, কারণ, যোগ্যতর মেয়েদের তারা ভয় পায়, মনে করে যোগ্যতার এই তারতম্য ভবিষ্যৎ জীবনে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে৷ আমাদের সমাজে এই কথাগুলো অনেক বেশি প্রযোজ্য।
লিভ টুগেদার! পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে নানান মত । যারা মনে করেন বিয়েটা হলো একটা কাগজে স্বাক্ষর কিংবা কিছু সামাজিকতা পালন, তারাই সোচ্চার হন বিয়ে প্রথার বিরুদ্ধে। কম হলেও এদেশেও অনেকে বেছে নিয়েছেন বিবাহ বহির্ভুত একসঙ্গে, একই ছাদের নিচে জীবন কাটানোর পথ। প্রচলিত আছে, লিভ টুগেদারে জীবন যাপনের স্বাধীনতা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। কিন্তু এখানেও পুরুষতান্ত্রিকতা অত্যন্ত নিম্নমানের আক্রমণ করে। এদেশি পুরুষরা বহুদিন একত্রে বসবাসের পর উপলব্ধি করে, বিয়ে তো আসলেই বিয়ে! বিয়ে না করলে কি আর ঘরকে ঘর মনে হয়, সংসারকে সংসার মনে হয়, বউকে বউ মনে হয়!
সব থেকে খারাপ অবস্থায় থাকে ‘একলা নারী’। যারা একলা থাকতে চায়, সমাজ তাকে বার বার মনে করিয়ে দেয়, নারী তোমার একলা থাকার অধিকার নেই। চারপাশে ফিসফিস আওয়াজ ওঠে, নিশ্চয়ই এই মেয়ের স্বভাব খারাপ, নয়তো কেন তার কেউ জুটবে না? এ সমাজ মেনে নিতে পারে না একটা মেয়ে একলা থাকার অধিকার রাখে। নানান পুরুষ মনে করে ‘একলা থাকা নারী’ সব থেকে সহজলোভ্য আর সহজভোগ্য!
এর বাইরে নারীর প্রতি বর্বর সহিংসতা, নিপীড়ন তো আছেই। এতো লড়াই সংগ্রাম করেও নারীর একটা নিজস্ব কামরা (ভার্জিনিয়া উলফের ভাষায়-আ রুম অব ওয়ান্স ঔন) পাওয়া হয়ে ওঠে না। আর কেন পাওয়া হলো না তা বলতে গেলেই প্রগতিশীলতার অনেকগুলো মুখোশ যে খুলে পড়বে!