সোভিয়েত নারীর দেশে

59267_493165281123_6290323_nসুপ্রীতি ধর: লেখার নামকরণ করেছে আমারই এক বন্ধু। ছোটবেলায় আমাদের অনেকেরই দেশটির সাথে পরিচয় হয়েছিল সোভিয়েত নারী বলে একটা পত্রিকার মাধ্যমে। সেই থেকেই দেশটির সাথে অচ্ছেদ্য বন্ধন আমাদের অনেকেরই। তাই এই নামকরণ।

তারপর আর্কাদি গাইদারের ইশকুল, কাশতানকা, আরও একটু বড় হলে ইস্পাত, মা, আন্না কারেনিনার স্পর্শে জীবনটাই অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। পরে যখন কলেজ পাশ করে ওইদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল সত্যি সত্যি, তখন গল্পে পড়া মানুষগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল আমার জীবনে। সেও তো কতদিন আগের কথা।

সাড়ে নয় বছর ছিলাম আমি দেশটিতে। কত ভাঙা-গড়ার মাঝ দিয়েই কেটে গেছে জীবন। ভেঙেছে যেমন দেশ, তেমনি ভেঙেছি আমরাও। সেই সবই আজ স্মৃতি। দীর্ঘদিন বললে ভুল বলা হবে, দীর্ঘ বছর ধরে নিজের ভেতরে একটা তাগিদ অনুভব করছি আমার সোভিয়েত জীবন নিয়ে লিখবো। এ নিয়ে বন্ধু-সহকর্মীদের তাড়াও ছিল ব্যাপক। একসময় তারা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি ছাড়িনি। আমি জানতাম যে, এটা আমার লেখা উচিত। আড্ডায়, কথায় সুযোগ পেলেই আমি সোভিয়েত জীবনের গল্প করি, এসব শুনে বন্ধুমহলে আমার বদনামও আছে এই বলে যে, তিন থেকে চার বাক্য পড়েই আমি নাকি দেশ ছেড়ে বিদেশের গল্প করি। হবে হয়তো। আমি এই বদনামকে মাথা পেতে নিই।

আমাদের খুব কাছের শামীম আপা, চলচ্চিত্রকার শামীম আক্তার, সবসময় বলেন, ‘ওই জীবনটা তোমার খুব সুন্দর কেটেছে, তাই ওটাই তোমার চিন্তায়-চেতনায় বাঁধা পড়ে আছে’। মনে মনে বলি, কোথায় যে আটকা পড়ে আছে, সেটা যদি আমি নিজেও জানতাম।

দৈনিক প্রথম আলোতে চাকরি করার সময় সহকর্মীরা খুব ক্ষেপাতো আমাকে, জাহীদ রেজা নূর আর মশিউল আলমকে নিয়ে। আমাদের ভিতরকার বন্ধুত্ব ওদের মনে চমক সৃষ্টি করতো। আমি ওদের তখন একটি কথাই বলতাম, জীবনের যে সময়টা তোমরা পার করেছো স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে, গুলি খেয়ে, মার খেয়ে, চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে, আমরা তখন নেভা নদীর পাশে বন্ধুদের হাত ধরে হেঁটে বেড়িয়েছি, চিৎকার করে কবিতা আওড়িয়েছি। দুই জীবনে তফাত তো থাকবেই! ওরা হাসতো, বুঝতো কিনা জানা হয়নি কখনও।

একটা লেখা শুরু করতে গিয়ে কতকিছুই না মাথায় আসছে, কোথা থেকে শুরু করবো, কি লিখবো। ধান ভানতে আবার শিবের গীত গাইতে বসবো না তো! সোভিয়েত জীবনের কথা বলতে গিয়ে যদি ওখানকার রাজনৈতিক সিস্টেমটা চলেই আসে, আপনারা কিছু মনে করবেন না। ওটা এমনই এক সিস্টেম, যেটাতে আপনি চলবেন-ফিরবেন-খাবেন-থাকবেন, সিস্টেমের শিক্ষা আপনাকে ঘিরে থাকবে। আপনি বুঝতেও পারবেন না, কী এক ঘোর, কী এক নেশা আপনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তবে এতো বছর পর এখন নিশ্চয়ই আর কেউ আমাদের মতোন মোহগ্রস্ত হয় না, হলেও সে হবে অন্য মোহ।

আমি বলবো আমার জীবনের কথা, সেই ১৯৮৬ সালের ৬ই অক্টোবর যখন এরোফ্লোটের একটি বিমান আমাকে নিয়ে আকাশে উড়াল দিল, সেই আমার কথা। পরদিন ৭ তারিখে যখন সে মস্কোর মাটি স্পর্শ করলো এক ভেজা ভেজা ঠাণ্ডার সকালে, জীবনের প্রথম সেই উনিশে পা দেওয়া আমি মাকে ছেড়ে, চেনা গণ্ডি ছেড়ে বহু দূরে। মানুষ অচেনা, ভাষা অচেনা, আমার যেন পুনর্জন্ম হয়েছিল সেদিন।

তারপর কতদিন, কত বছর, কত সুখ, কত দু:খ পার করে দিয়েছি নিজের জীবনে, সামষ্টিক জীবনে, দেশটির রাজনৈতিক জীবনেও। নিজেকে অনেক বড় সৌভাগ্যমান মনে করি এই কারণে যে, আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন দেশটিতে ছিল পেরেস্ত্রোইকা, গ্লাসনস্তের যুগ, আস্তে আস্তে করে ভেঙ্গে যাচ্ছিল একটি দেশ, বহু বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, চোখের সামনে ভেঙ্গেও গেল সব, আমরা আর সবার মতোই নতুন যুদ্ধে নামি টিকে থাকার আশায়। সবার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে রুটি কিনি, ভাত ছাড়া চলতো না বলে ব্ল্যাকে চাল কিনি, কুপন পাল্টে চালের কুপন নেই রুশদের কাছ থেকে, বিনিময়ে তাদের হাতে তুলে দেই সুজি, আটার কুপন। সেই সময়টাতে আমি আবার মেয়েকে ধারণ করছিলাম পেটে। খিদে ছিল আমার আকাশচুম্বি, কিন্তু বন্ধুরা কেউ কোনদিন আমার সেই অভাব রাখেনি। ওরা কোন না কোন উপায়ে ঠিকই আমার খাবার জোগাড় করে আনতো, সেই প্রচণ্ড দু:সময়েও। এমনকি ডাক্তার, যারা আমার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, তারাও আমার রুমে আসার আগে হাতে করে চালের প্যাকেট নিয়ে আসতেন।

কী সব দিন ছিল তখন! মেয়েটা যখন হয়, সেটা ১৯৯১ সাল। স্বাস্থ্যসেবা খাত তখন অল্প অল্প করে বেসরকারি পর্যায়ে চলে যেতে শুরু করেছে। আমিও অধিক সেবা পাওয়ার আশায় হাসপাতালেরই ছোট পরিসরে গড়ে উঠা বেসরকারি সুবিধা পেতে চাইলাম। কিন্তু একা টিকতে না পেরে চলে এলাম গণমানুষের মাঝে। একা ছিলাম বলে আমার যিনি ডাক্তার ছিলেন, তিনি বাসা থেকে প্রতিদিন এটা-সেটা নিয়ে আসতেন আমার জন্য, আর বলতেন, এবার হাসো তো! আমি হাসতাম, আর আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তো, আনন্দের, নাকি কষ্টের, জানা হয়নি কখনও।

হাসপাতাল ছাড়ার পর ডাক্তারের কাছে বিল চাইলে তারা আমাকে বললেন, ‘আমরা ঠিক করেছি, তোমার কাছ থেকে টাকা নেবো না, মেয়েটাকে বড় কর, সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া’। আমি থ হয়ে গেলাম, মানুষের ভালবাসা আর ডাক্তারদের নৈতিকতার কাছে হার মেনে জীবনে আরও একটু শিক্ষিত হওয়ার প্রয়াস পেলাম।

পড়তাম তৎকালীন লেনিনগ্রাদ বা বর্তমান সেন্ট পিটার্সবুর্গ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। আমি ছাড়া তখন বাংলাদেশি কেউ ছিল না সেই ভার্সিটিতে, কিন্তু ভারতীয় বাঙালী ছিল। সেই বাঙালী-অবাঙালী, আমার ভিনদেশি রুমমেট, সবার  সাথেই ছিল আমার সখ্য। সারাদিনরাত লেপ্টে থাকতাম একে-অপরের সাথে।

বলা চলে আমি ছিলাম আন্তর্জাতিক। সেই অভিজ্ঞতাই আমার আজকের জীবনে সবচেয়ে বড় পাথেয়। সেদিনকার কথাগুলোই এখন থেকে লিখবো ধারাবাহিকভাবে। আশা করি, বরাবরের মতো এবারও আপনাদের পাশে পাবো।

শেয়ার করুন: