রোজ নামচা- ১৩

Leena Haq
লীনা হক

লীনা হক: আজ এপ্রিলের ৬ তারিখ (২০১৪)। আজকে আমার বড্ড ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। আমার ছোট ভাই শাকিল, সে আমার একটি লেখা তার ফেসবুকে শেয়ার করেছে। লেখাটির সাহিত্য মূল্য আদৌ আছে কিনা সে নিয়ে তর্ক করাও সময় নষ্ট। কিন্তু আমার ভাই লেখাটি শেয়ার করে একটি মন্তব্য দিয়েছে বা বলা চলে স্টেটমেন্ট দিয়েছে। সেই স্টেটমেন্টটি আজ আমাকে সারাদিন ঘুরেফিরে ছেলেবেলায় নিয়ে গেছে।

শাকিল, আমার ভাই, এখন অনেক বড় হয়েছে, হয়তো জাতীয়ভাবেই লোকে তাকে চেনে। কিন্তু সে আমার কাছে সেই ভাইটিই রয়ে গেছে যে সর্বক্ষণ আমার পিছনে পিছনে ঘুরতো, মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে জিলা স্কুলে চলে আসার আগ পর্যন্ত আমি ছাড়া যার তেমন কোন বন্ধু ছিল না। আমার সাথে সর্বক্ষণ রেষারেষি আমাদের দাদীমা কাকে বেশী ভালবাসেন সেই নিয়ে, আবার আমার সালোয়ার পরে স্কুলের মিলাদে যাওয়া। মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের সিঁড়ি থেকে পরে গিয়ে শাকিলের মাথা কেটে গেছে, এই খবরে মনে হয়েছিল যেন আমারই মাথায় আঘাত লেগেছে।

শাকিল তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে, আর আমি খুব সম্ভবত ক্লাস সিক্স। আমরা বেড়ে উঠেছি ব্রহ্মপুত্র তীরের নিরিবিলি শহর ময়মনসিংহে। আমাদের কৈশোরে বই পড়াই ছিল মূল বিনোদন| কুয়াশা, দস্যু বনহুর থেকে শুরু করে চিত্রালী, পূর্বাণী, মাসুদ রানা, নীহার রঞ্জন, নিমাই ভট্টাচার্য্য সবই পড়তাম | সর্বভূক ছিলাম বই পড়াতে| খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন, এমনকি ঠোঙ্গার কাগজও পড়তাম !

আমাদের ছোট খালা তাঁর কানাডা যাত্রার প্রাক্কালে বিয়েতে উপহার পাওয়া সব বই আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন| কালো সেই টিনের ট্রাঙ্কটি রাখা ছিল শোবার ঘরের খাটের পিছনে| হঠাতই একদিন কিভাবে যেনো আমি আর শাকিল আবিষ্কার করলাম সেই কালো রঙের টিনের ট্রাঙ্কের ভিতরে আলী বাবার রত্ন ভাণ্ডার।

কার বই ছিল না সেখানে- জীবনানন্দ দাশ , সৈয়দ মুজতবা আলী, আশাপূর্ণা দেবী, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন, বিমল মিত্র, শৈলজানন্দ, তারাশংকর, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল, কৃষণ চন্দর, সাদাত হাসান মানটো, খুশবন্ত সিং এর ট্রেন টু পাকিস্তান, পাবলো নেরুদার কবিতার বই, চে গুয়েভারার জীবনী, সর্বোপরি রবি ঠাকুর| আমি আর শাকিল প্রায় গোগ্রাসে গিলতাম সেই সব বই, কিছু বই পড়তে আবার বড়দের মানা ছিল, আমরা সেগুলিকে পুরোনো ক্যালেন্ডারের মলাট দিয়ে পড়তাম| এক একটা বই যে কত বার করে পড়তাম|

বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ পড়ে মহাজ্ঞানী দুইজন একমত হলাম বইয়ের শেষটা কেমন জানি খাপছাড়া! সেই সব দিন….. আবার লিখতামও আমরা। নিজেদের মধ্যে একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করতাম। লম্বা ফুল স্কেপ নিউজ প্রিন্টের কাগজে গল্প, প্রবন্ধ লিখতাম। সোভিয়েত নারী নামে একটা পত্রিকা ছিল সেই সময়, সেখান থেকে সুন্দর সুন্দর ছবি কেটে আমাদের সেই পত্রিকার শোভা বর্ধন করতাম। আমি এবং শাকিল, দুজনেরই আঁকার হাত- কি আর বলব! স্কুলের পরীক্ষার খাতায় কোনরকমে টায় টায় পাশ করিয়ে দিতেন স্যারেরা।

সেই পত্রিকার লেখক এবং পাঠক আমরা দুই ভাই-বোনই। অন্য ভাইবোন কেউ আমাদের মতন উচ্চশ্রেণীর প্রাণীতে পরিণত হয় নাই। পরিবারের বিশিষ্ট এই দুই বুদ্ধিজীবীর মধ্যে আমার বরাবরই ঝোঁক ছিল বর্ণনা ধরনের লেখায়, আর শাকিল কবিতা আর গল্প লেখার চেষ্টা করত। রবার্ট ফ্রস্টের একটা কবিতা আমাদের দুই ভাইবোনেরই খুব পছন্দ। আমরা রবার্ট ফ্রস্টের হয়ে সুন্দর হাতের লেখায় সেই কবিতাটি আমাদের পত্রিকায় কপি করতাম। বড় হয়ে লেখক হবার সেই স্বপ্ন কেউই সত্যি করতে পারিনি।

শাকিল লেগে থাকলে অনেক চমৎকার লেখা- কবিতা বিশেষ করে পেতে পারতাম আমরা। লেখেনি সে। আর আমি তো জীবন প্রায় দৌড়েই পাড়ি দিলাম। লেখক হতে পারিনি দুজনের কেউই, কিন্তু লেখার একটা তাগিদ রয়ে গেছে আমাদের দু ভাই বোনের হৃদয়ের মধ্যে! কি জানি কেন আমাদেরকে সবথেকে বেশি টানত ইতিহাস | ছোট খালার ট্র্যাঙ্কের বই এর মধ্যে ছিল পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস বলে চারটি খণ্ড। খুব সম্ভবত কে আলী’র লেখা| ক্লাস নাইনে উঠার পরে ভূগোল পড়ার জন্য মানচিত্র লাগবে, আমার ঘ্যান ঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে মা আমাকে একটি ইংরেজি এটলাস কিনে দিলেন | ছুটির দিনে সারা দুপুর-বিকেল আমি আর শাকিল মানচিত্র খুঁজে খুঁজে ঐতিহাসিক জায়গাগুলো বের করতাম, পরিকল্পনা করতাম বড় হয়ে একসাথে আমরা সেই সব জায়গায় যাব | আমিতো মোটামুটি ইতিহাসের সাথে জড়িত জায়গাগুলোর অনেকগুলোই দেখেছি, শাকিলও গিয়েছে অনেক জায়গায়| কিন্তু আমাদের দুই ভাই বোনের সেই ইতিহাস যাত্রা কোনদিন আর হয়ে উঠে নাই!

এখনো স্পষ্ট দেখি ঘুম ঘুম দুপুরে মাটিতে পাটি বিছিয়ে মানচিত্র খুলে কিশোর দুই ভাই বোন ইতিহাস আর ভূগোল মিশ্রিত এক ভ্রমণ পরিকল্পনায় রত | একই শহরে থাকি কিন্তু ভাইয়ের সাথে দেখা হয় ঈদের সময় ময়মনসিংহে গিয়ে …ফেসবুকে লেখা শেয়ার করি, কিন্তু ফোন তুলে কথা বলি না…কাউকে দোষারোপ তো করছি না…এটাই হয়তো হয়…এটাই তো হওয়ার কথা ছিল বোধ হয় ……।

তবু শাকিল, চল, দুজনে মিলে আমাদের ছোটবেলাটা লিখে ফেলি এই বেলা। ছেলেমেয়েরা জানুক কেমন ছিল তাদের মা, মামা কি বাবা ফুপুদের শৈশব, কৈশোর! যেন তারা দিনে একবার হলেও ঘুরে আসে তাদের ছেলেবেলা থেকে…মনে মনে!

শেয়ার করুন: