যৌন হয়রানি এবং আমাদের দায়

Eve Teasing 2 উইমেন চ্যাপ্টার: “উত্ত্যক্তকারীকে শাস্তি দেয়ায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় এক মাদ্রাসা শিক্ষককে প্রকাশ্যে গলা কেটে হত্যা করেছে এক দুর্বৃত্ত। ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র গতকাল ৫ এপ্রিল ২০১৪। এ ব্যাপারে স্থানীয় ডিগ্রির চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফণীন্দ্রনাথ জানান, মাস খানেক আগে রুহুল আমিন এক মেয়েকে উত্ত্যক্ত করলে মাদ্রাসা শিক্ষক নজরুল ইসলাম(৬৫) বিষয়টি স্থানীয়দের জানান এবং এরপর একটি সালিশ বসে। ওই সালিশে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শাস্তিস্বরূপ রুহুল আমিনকে(৩১)একদিন পুকুরের পানিতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এ কারণেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে রুহুল আমিন”।

বখাটেদের আধিপত্যের একটি চিরচেনা রূপ এই ঘটনা। এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে। আমরা কতক এর খবর পাই, কতক পাই না। আজ থেকে দুই দশক-তিন দশক আগেও রাস্তাঘাটে হয়রানি করা হতো স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের। নানা ধরনের কটূক্তি করা হতো। এখনকার মেয়েরা সময়ের হিসাবে স্মার্ট মনে হলেও, আমার মনে আছে, তখনকার মেয়েরা বেশ ভালোই জবাব দিতো সেসব উত্ত্যক্তকারীকে। কটূক্তির পাল্টা জবাব দিতেও পিছপা হতো না। কেন জানি অতটা ভয় তখন ছিল না মেয়েদের মনে। বিষয়টা শেষপর্যণ্ত অভিভাবক পর্যায় পর্যন্তও গড়াতো। দোষীকে শাস্তি পেতে হতো।

eve teasing 2কিন্তু বর্তমান সময়ে এর উল্টো চিত্রই দেখি আমরা। হতে পারে ডিজিটাল যুগে বখাটেদের দৌরাত্ম্য আরও অনেক দূর অব্দি পৌঁছে যাওয়ায় অপরাধ সংঘটনের মাত্রাও বেড়ে গেছে, সেইসাথে বেড়েছে অপরাধের মাত্রাও। এখন কেউ নির্দ্দিষ্ট করে বলতে পারে না, এর প্রতিবাদ করলে তার ভাগ্যে কী থাকতে পারে? বখাটেদের হাত কতদূর বিস্তৃত হতে পারে? আইন যেখানে নীরব থাকে, অপরাধীদের পক্ষে থাকে, তখন প্রতিবাদ করেই বা কতদূর যাওয়া যাবে?

এই সময়ে বিশেষ করে সাইবার অপরাধের প্রধান বলি হচ্ছে উঠতি বয়সি মেয়েরা। এইতো মাত্র কিছুদিন আগেই কুষ্টিয়ার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের কুকীর্তির খবরে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে ধরাও হয়েছিল। কিন্তু শাস্তি কি হয়েছে? আর জানতে পারিনি আমরা। অথচ দেড়শ ছাত্রীর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ওই শিক্ষকের কারণে। ফুসলিয়ে, নানারকম লোভ-প্রলোভন দেখিয়ে, কখনও কখনও ভয়-ভীতি দেখিয়ে ওই শিক্ষক ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। পরে সময় বুঝে সেগুলোর ভিডিও বাজারে ছেড়ে দেয় সে। মেয়েগুলোর অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই দু:সহ হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে সংসারে প্রবেশ করা অনেক প্রাক্তন ছাত্রীর ঘর ভাঙার ঘটনা পর্যণ্ত ঘটতে শোনা গেছে।

Eve Teasing 1ওপরের ঘটনাটি মারাত্মক অপরাধ বলেই গণ্য হওয়ার কথা। তাছাড়া এখন মোবাইল ফোনের যুগ। উঠতি বয়সেই ছেলেমেয়েদের হাতে উঠছে এই প্রযুক্তি। এর ফলে এটা ধারণ করার মতো যথেষ্ট মানসিক শিক্ষা যখন গড়েই উঠছে না, ঠিক তখনই তারা এর ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ন্যায়বোধ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা এসব শেখার আগেই কিশোর-তরুণরা প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার করতে শিখছে। এর ফল হচ্ছে মারাত্মক। আমার জানা এক কিশোর ছেলের মোবাইল বার্তা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম। সে তারই ক্লাসফ্রেন্ডের সাথে অনায়াসে সেক্স নিয়ে কথা বলছে, নারীর শরীর নিয়ে কটূক্তি করছে, ঋতুস্রাব নিয়ে কথা বলছে। ওদিকে কিশোরী মেয়েটিও হয়তো তা উপভোগই করেছে, নইলে সেইবা এই কথোপকথন চালিয়ে গেল কীভাবে?

তবে ওই কিশোরের ফোনে শুধু একটি মেয়েই নয়, এমন আরও কয়েকটি মেয়ে আছে, যাদের সাথে একই সময়ে প্রায় একই কথা বলেছে। তাহলে কী দাঁড়ালো? রাতভর ইন্টারনেটে পর্নোসাইট দেখে দেখে মানসিকভাবে সুস্থ হওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিচ্ছে উঠতি বয়সীরা। তারা না পারছে নিজেদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাতে, না পারছে সহ্য করতে। জোর করে অবদমন করতে গিয়ে এর উল্টো ফল ফলছে সমাজে। জন্ম দিচ্ছে অপরাধের। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও কিশোর অপরাধের পিছনে এই কারণগুলোকেই দায়ী করা হচ্ছে। কয়েকটি স্কুলে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার পিছনেও এসব হতাশাকেই দায়ী করা হচ্ছে।

eve teasing 3কাজেই এটা বলা যায় যে,  হয়রানির একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি তথা মোবাইল ফোনের অবাধ ব্যবহার। তথ্যপ্রযুক্তির এই অগ্রগতিকে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অনেকেই সাধুবাদ জানালেও এর নেতিবাচক দিকটাও আমাদের বেশি নাড়া দিচ্ছে। কর্পোরেট কোম্পানিগুলো শুধু মুনাফার লোভে সামাজিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে ইঁদুরদৌড়ে মেতে উঠেছে। ‘রাতভর কথা’, ‘বিরামহীন কথা’ ইত্যাদি প্যাকেজ দিয়ে তারা আমাদের উঠতি বয়সীদের জীভন কিভাবে বিষিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা কেউ ভাবছে না। আর এভাবেই জন্ম হচ্ছে হাজারো ‘স্ট্রিট রোমিও’র। যারা কিনা পরে ভয়ানক ভিলেনে রূপান্তরিত হচ্ছে।

আরেকটি কারণ হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভীষণভাবে মুখ থুবড়ে পড়া। দেশীয় নিজস্ব সংস্কৃতিক পরিচয়ের বিকাশের অভাবই তরুণ প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে এক অনাকাঙ্খিত জীবনের দিকে। তথাকথিত অত্যাধুনিক বিশ্ব আর বিশ্বায়নের সাথে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করে ভিনদেশী সংস্কৃতির অবাধ গলাধঃকরণ নিশ্চিত করেছি। দিনশেষে দেখা যাচ্ছে আমাদের অপ্রস্তুত তরুণ সমাজে তার বদহজম শুরু হয়েছে। ভালোমন্দের পরিশোধন করতে না পেরে তারা সবই অবাধে গ্রহণ করার চেষ্টা করছে কিন্তু ঠিকভাবে পেরে উঠছে না। ফলে তৈরি হচ্ছে হিংস্র ও পশুসুলভ আচরণের। বলি হচ্ছে শত শত কোমলমতি মেয়ে। আর এক্ষেত্রেও প্রভাবকের ভূমিকায় রয়েছে সেই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।

যৌন হয়রানিতে আক্রান্তদের শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেও ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পরে। তারা ভয়,  উদ্বেগ (Anxiety),  দুঃশ্চিন্তা, আত্মহত্যার প্রবণতা, অসহায়ত্ব, হতাশা, আত্মসম্মান বোধের হ্রাস ইত্যাদি মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকে। যেহেতু পরিবার বা স্কুলে এ ব্যাপারে সাধারণত তারা পর্যাপ্ত মনো-সামাজিক সহযোগিতা পায়না বা পাবার ব্যবস্থাও নেই, সমস্যাগুলো পর্যায়ক্রমে প্রকট হতে থাকে।

এদিকে বিবিধ যৌন হয়রানির শিকার হয়ে অনেক কিশোরী মেয়েরই জীবন থেমে যাচ্ছে, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে এর প্রভাব খুবই নেতিবাচক। কেবল যে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হলেই আমরা তাকে যৌন হয়রানি বলছি তা নয়, নানা অঙ্গভঙ্গি, অশ্লীল ভাষা দিয়ে বা খুব কাছের মানুষ ছাড়া নানা ছলচাতুরি করে গায়ে হাত দেওয়াও এ ধরনের হয়রানির পর্যায়েই পড়ে।

সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী মেয়েদের শতকরা ৮০ ভাগই কমবেশি ইভ টিজিং এর শিকার হচ্ছে। কোথাও এর হার বেশি, কোথাও হয়তো কম। তবে কেবলমাত্র এশিয়ার দেশগুলোতেই মেয়েরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় বলে এতোদিন যে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল, তা পাল্টে দিয়েছে সাম্প্রতিক কালের এই জরিপ।

জরিপে বলা হয়েছে, এই ধরনের হয়রানি এখন কেবল আঞ্চলিক সমস্যাই নয়, এটা বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বব্যাপী শতকরা প্রায় আশি ভাগ নারী এবং ভিন্ন সেক্সের অন্য লোকজনও রাস্তাঘাটে উত্যক্ত হচ্ছে নানাভাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে আত্মাহুতির ঘটনাও হরহামেশাই ঘটছে।

এসব হয়রানির মধ্যে রাস্তাঘাটে শিস বাজানো থেকে শুরু করে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য, হাসির জন্য আমন্ত্রণ, ফোন নম্বর দাবি, অথবা বেশ্যা বলে গালিও হতে পারে। এবং এটার শেষ হতে পারে মারাত্মক রকমের অপরাধ সংঘটনের মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জে চারুকলার ছাত্রী সিমির আত্মহত্যার ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। সমসাময়িক আরও বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা তখন আমরা জানতে পারি। আর সবগুলোরই বিয়োগান্তক পরিণতি হয়েছিল। তখন প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মহলগুলো কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও তা বেশিদিন কার্যকর থাকেনি। দেশজুড়ে আলোচিত এই সিমি আত্মহত্যার ঘটনাটিতেও আমরা দেখেছি, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজে সিমিকেই কথা শুনতে হয়েছে এসব হয়রানির জন্য। ফলে বখাটেরা পার পেয়ে গেছে সহজেই।

পরবর্তীতে আমরা আরও কিছু ঘটনার সাক্ষী হই।

এসব হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। এর মধ্যে নাটোরের একজন শিক্ষক ছাত্রীকে হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে প্রাণ হারান। ফরিদপুরে এক মা তার মেয়েকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় মোটর সাইকেলের নিচে পিষ্ট করে সেই মাকে মেরে ফেলে বখাটেরা।

ওই সময়ে বখাটেদের ঔদ্ধত্যের আরও কিছু খবর আসে গণমাধ্যমে। কিন্তু কোনটারই সঠিক বিচার হয়েছে কিনা তা আমরা আর জানতে পারি না। শুধু ইভ টিজিং শব্দটা ব্যবহারের ওপর তখন প্রাতিষ্ঠানিক একটা রূপ দেয়া হয়েছিল। আর এই প্রাতিষ্ঠানিকতায় আইনের কিছু ধারাও বলবৎ করা হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই আইনগুলোর কোন সুনির্দ্দিষ্ট প্রয়োগের খবর আমরা পাইনি। বিষয়টা অনেকটা এরকম, ‘আইনের কথা খাতায় আছে, বাস্তবে নেই’।

আবার আমাদের সমাজটা এখনও পর্যন্ত বদলায়নি। এখনও আমরা ইভটিজিংয়ের জন্য ঘরের মেয়েটাকেই দায়ী করি, তার চলাফেরা, আচার-আচরণ, পোশাক এসবকিছুকেই দায়ী করে মোটামুটিভাবে তাকে গৃহবন্দী করে রাখার প্রয়াস খুঁজি। কিন্তু ভেবে দেখি না, একটি তিনবছরের শিশু যখন ধর্ষণের শিকার হয়, তখন তার কোন আচরণটা প্রলুব্ধ করেছিল ওই ধর্ষককে? বা কোন পোশাকটাই?

টিজিংয়ের সবচেয়ে শিকার আমাদের কিশোরী মেয়েরা। এমনিতেই উঠতি বয়স, শরীরে নানান পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে যে কিনা নিজেই হিমশিম খায়, সেই তখন চারদিকের লোলুপ দৃষ্টিগুলোর সামনে পড়ে অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়ে। কোনদিকে যাবে সে? কি করলে ভাল হবে? পরিবারের বড়রা তখন কমই তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, কাঁধে নির্ভরতার হাতটি রেখে সঠিক পথটি বাতলে দেয়। ফলে টিজিংয়ের শিকার কিশোরীটি না পারে কাউকে কিছু বলতে, না পারে সইতে।

আর রাষ্ট্রও যখন নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, তখন নাগরিক হয় নিজেই প্রতিবাদী হয়, নয়তো নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টিই হতে দেখি আমরা। আর এই গুটিয়ে যাওয়া থেকে সমাজে তৈরি হচ্ছে একধরনের ভারসাম্যহীনতা। ক্ষতিগ্রস্তরা নিজে থেকেই তাদের চলাফেরার গণ্ডি সীমিত করে ফেলে নিরাপত্তার কথা ভেবে। এটা খুব বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। তবে এটা এভাবে বেশিদিন চলতে দেয়া যায় না, এর এখানেই সমাপ্তি হওয়া উচিত।

আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। নিজের ঘরেও একটি মেয়ে নিরাপদ থাকতে পারছে না। কিছুদিন আগেই আমরা এক মাকে দেখেছি মেয়েকে উত্ত্যক্তকারীকে কুপিয়ে মারতে। সেই মা স্বীকারও করেছেন তার অপরাধ। আর এটি দিনের পর দিন হচ্ছিল নিজের ঘরেই, নিজের লোকের মাধ্যমেই।

বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে হয়রানিও এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হয়রানি এখন শারীরিক-মানসিক সব গণ্ডিকেই পেরিয়ে গেছে। আর এর শিকার হয়ে কত মেয়ে যে অকালে চলে যাচ্ছে, তার হিসাব কি গণমাধ্যমে সঠিকভাবে আসে?

নোয়াখালীতে ক্লাশ টেনের একটি মেয়ে এরকম একটি ঘটনার শিকার হয়ে গাছে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলো। লাশটা পরদিন দুপুর পর্যন্ত গাছে ঝুলে রইলো, পরিবারের মা-বাবা কেউই কাউকে খবর দিল না। পুলিশ আসার পর ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়া হলো। সাংবাদিকরাও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করলো না।

তাহলে আমরা কি কেবল হাতি গুটিয়েই বসে থাকবো? কি কি করতে পারি? এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি প্রস্তাব রাখা হয়েছে। যেমন,

১. ভাল উদাহরণ তৈরি করতে পারি, শ্রদ্ধাশীল হতে পারি।

২. আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে পারি, যতো বেশি শেয়ার করবো, ততবেশি সচেতন হবে অন্যরা। এতে করে সহায়তার বিষয়টিও সামনে চলে আসে।

৩. হয়রানি যারা করছে, তাদের মুখের ওপর বলতে শেখা, ‘এই যে, এটা ঠিক করছো না’, ‘ভাল হয়ে যাও’, ‘এ ধরনের হয়রানি বন্ধ কর’, জিজ্ঞাসা করতে পারি, ‘আপনি কি আবার বলবেন, যা বলছিলেন’, অথবা ‘আপনি কি চান, আপনার মা শুনুক, আপনি কি বলছেন’। আমরা এ ধরনের হয়রানির বিষয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্টও করতে পারি, যদি ওই ব্যক্তির ছবি থাকে, তাহলে ছবিসহ।

৪. রাস্তাঘাটে আমরা যখন কাউকে হয়রানির শিকার হতে দেখি, তখন নিজেরাও যেন প্রতিবাদে এগিয়ে যাই। আমরা নির্যাতিতকে জিজ্ঞাসা করতে পারি, সে কোন সাহায্য চায় কিনা এবং সহায়তার প্রস্তাবও দিতে পারি। আমরা সরাসরি উত্যক্তকারীকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি, নির্যাতিত ব্যক্তিকে আমি চিনি, এমন একটা ভাব করে সহজেই ওই অবস্থা থেকে তাকে বের করে আনতে পারি।

৫. কমিউনিটিকে এ ব্যাপারে সচেতন করে একত্রিত করতে হবে। কোন ইভেন্ট সংগঠিত করা যায় কোন ঘটনার প্রতিবাদে, লেখালেখি করা যায় সংশ্লিষ্ট মহলে, তরুণদের একাজে সম্পৃক্ত করে উৎসাহিত করা যায়।

রাস্তাঘাটে হয়রানি প্রসঙ্গে ফেসবুকে একজন তার প্রতিক্রিয়া এভাবেই জানালেন, ‘শুধুমাত্র মানুষের মাঝে আমি আছি, এর মানে এই নয় যে, আমি ‘গণিমতের মাল’ হয়ে গেলাম। তোমার প্রতি আমার কোন দেনা-পাওনা নেই, এবং আমি তোমার জন্যও আসিনি রাস্তায়’।

আরেকজন বললেন, ‘যখন আমি পুরুষের পাশাপাশি রাস্তায় হাঁটি, আমি চাই না, সেই পুরুষটি আমাকে কিছু বলুক। আমি শুধু কোন ঝামেলা ছাড়াই আমার গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই’। এক মা লিখেছেন, ‘আমি আমার মেয়েকে ১৮ বছর পর্যণ্ত প্রায় আগলে রেখেছি, কোন ধরনের বাজে স্পর্শ তাকে ছুঁতে পারেনি। কিন্তু এভাবে কতদিন? আমি চাই, মেয়েটা আমার নিজেকে হাজারো মানুষের মাঝেও নিরাপদ ভাবুক’।

রাস্তাঘাটে হয়রানি বন্ধে চারটি পদক্ষেপের কথা প্রস্তাব করা হয়েছে:

১. সমাজে রাস্তায় হয়রানির বিষয়টি কমপ্লিমেন্ট হিসেবে দেখা যাবে না, এটা ছোটখাটো অপরাধ বলেও গণ্য করা যাবে না, এমনকি হয়রানির শিকার ব্যক্তির দোষ বলেও ধরা যাবে না।

২. যারা হয়রানির শিকার, তাদের সত্যিকার সহায়তায় এগিয়ে আসুন। তাদেরকে বলতে হবে, বুঝাতে হবে যে, ক্ষমতায়নের প্রকৃত দৌড় কতখানি, কিভাবে এই সমস্যায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো যায়, আত্মরক্ষা এবং হয়রানির শিকার হলে কিভাবে তা জানানো উচিত অন্যদের।

৩. হয়রানি করতে পারে এমন লোকজনকে সনাক্ত করা, তাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, ছেলেরা ছেলেদের মতোই হবে, এই তত্ত্ব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাবা, ভাই, চাচা এবং বন্ধুদের উচিত হবে এসব মানুষকে (হয়রানি যারা করে) শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেরাও এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে না পড়া। যেসব সংস্থা ছেলেদের নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে শিক্ষা দেয়, সেইসব সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত করা সন্তানদের।

৪. আমাদের উচিত রাস্তাঘাটে হয়রানিমূলক মন্তব্যের চ্যালেঞ্জ করা, মাধ্যম যাই হোক না কেন, যেসব ক্ষেত্রে নারী এবং সেক্সুয়ালি ভিন্নতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যে নীতিমালাই অশ্রদ্ধা এবং বৈষম্য দেখাবে, তারই প্রতিবাদ জানানো। সব ধরনের জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা এবং হয়রানির বিরুদ্ধে আমাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে হবে। তবে এগুলো সবই আন্তসম্পর্কিত।

অত্যন্ত ভয়ানক হয়ে উঠা এই ব্যাধির দ্রুত প্রতিরোধ করার জন্য কঠোর শাস্তির বিধানের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতৈক্য একান্ত অপরিহার্য। ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যাবস্থা করাও জরুরী। সেই সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক বিকাশে ব্যবসায়ী,  রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের যে দায়িত্ব রয়েছে সে সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।

এ কথা সত্য যে, আজ যদি আমরা আমাদের মেয়েদের সহায়তা না করি, দিনশেষে আমরা সবাই চরম অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ব।

eve teasing 1পরিশেষে একটি কথাই বলবো, মেয়েদের প্রতি সম্মান জানানোর বিষয়টি আসলে আসে মূলত পরিবার থেকে। একটি শিশু জন্মের পর পরিবারের সবাইকে সে যা করতে দেখে, তাই শেখে। ওই পরিবারে নারী সদস্যদের কোন চোখে দেখা হয়, সেটি ওই শিশু অবস্থাতেই সে বুঝতে শেখে। বিশেষ করে মায়ের প্রতি বাবার আচরণ, বোনের প্রতি পরিবারের সবার আচরণ, নানী-দাদী, খালা-ফুপুর সাথে অন্যদের আচরণ, এসবই একটি শিশুকে বড় হতে সাহায্য করে। বড় হয়ে সে স্বাভাবিকভাবেই সেরকমই আচরণ করে, যা তার ভিতরে প্রোথিত হয়ে গেছে সেই শিশুকাল থেকে। হঠাৎ করে কেউ নারীবিদ্বেষী হয় না এবং নারীকে অসম্মান করাও শিখে যায় না।

একটা শিশুকে লালন-পালনের ক্ষেত্রে এটা মাথায় রাখা তাই অত্যন্ত জরুরি।

 

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.