উইমেন চ্যাপ্টার: একলা থাকা নিয়ে এপর্যন্ত বেশ কটি পর্ব ছাপা হয়েছে, পাঠকরা পড়েছেন। পছন্দ করেছেন,সমালোচনা করেছেন, নিজের সাথে মিল খুঁজে পেয়েছেন, কেউ বা আবার বলেছেন কি দরকার এইসব কথা লেখার! একা থাকার মধ্যে কি এমন বাহাদুরী আছে! কেউ বলেছেন, অশান্তিময় দোকলা থাকার চাইতে কষ্ট করে একা থাকা অনেক স্বস্তির, অনেকে আবার দার্শনিক ভাবে বলেছেন, পৃথিবীতে সব মানুষই একা!
এই ‘একলা থাকি’র স্পষ্ট অর্থ যারা আমাদের সামাজিক পরিভাষায় পুরো পরিবার নয়, তাদের কথা। আমাদের সামাজিক পরিভাষায় পুরো পরিবার মানে – বাবা মা (স্বামী-স্ত্রী)-সন্তান মিলে যে পরিবার। এই পুরো পরিবারের একটি মানুষ যদি কোন কারণে পরিবারের সাথে একত্রে থাকতে না পারে তাহলে সেই পরিবারকে চলিত ভাষায় ‘ভাঙ্গা পরিবার’ বা ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’ নাম দেয়া হয়। এই সো কলড ব্রোকেন পরিবারের মা’দের সংগ্রামের কথাই লিখতে চেয়েছিলাম শুরুতে।
আমি এখনো পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারি না ঠিক কি কারণে এই ‘ভাঙ্গা পরিবার’ বা ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’ বলা হয়। কথাটির মধ্যে এক ধরনের তাচ্ছিল্যবোধ আছে। বাসন ভাঙ্গতে পারে, কাপ পিরিচ ভেঙ্গে যায়, আয়না ভাঙ্গে, ফুলের টব ভাঙ্গে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে কংক্রিটের দেয়াল কি মজবুত টিনের চালও ভেঙ্গে যেতে পারে। পরিবার কিভাবে ভেঙ্গে যায় বুঝি না আমি। হয়তো বাবা কিংবা মা আলাদা হয়ে যাওয়া পরিবারটির সন্তানদের অন্ধকার (!) ভবিষ্যতের কথা বুঝাতেই এই শব্দটি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাবা বা মায়ের মৃত্যুতে একলা হয়ে যাওয়া কোন পরিবারকে ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’ বলি না আমরা।
আমি জানি না কারণটি। অবশ্য আমার জানার পরিধিই বা আর কতটুকু। এক সাথে থাকলেই যে পূর্ণাঙ্গ পরিবার, সেই গ্যারান্টিই বা দেয় কে! আসলে পূর্ণাঙ্গ পরিবারের সূচক বা পরিমাপকগুলো কি বা কেমন? সেই সব পরিমাপকগুলি কি সংখ্যাগত নাকি গুনগত? এক ছাদের নিচে থাকলেই কি একটি সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবার বলা যাবে? বাবা-মা আলাদা থাকলেই কি তাদের সন্তানদেরকে ‘ভাঙ্গা পরিবারের’ সন্তান বলে আলাদা চোখে দেখতে হবে?
কে গ্যারান্টি দেয় যে বাবা-মা একসাথে থাকলেই সে সন্তানরা ভাল থাকবে, ঠিকমত পড়াশুনো করবে, সৎ মানুষ হবে? কত পরিবারকে জানি, মা-বাবা একসাথে আছেন ঠিকই, কিন্তু দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। সেই পরিবারে না আছে শান্তি, না আছে ভালবাসার টান। আছেন তারা হয় সামাজিকতার দায়ভার মেটাতে আর নারীদের ক্ষেত্রে বেশীরভাগ নিজের অর্থনৈতিক অবস্থান শক্ত নয় বলে, আবার এমনও শুনি, মেয়ের বিয়ে হবে না যদি মা আলাদা হয়ে যায়।
তাই দাঁতে দাঁত চেপে থাকা এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চেপে থাকা দাঁতের ঘর্ষণে পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা কেটে কুচি কুচি হয়ে ছিটকে পরে, ক্রমাগত ঘষা লেগে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণত্বর হয়ে উঠে, সেই দাঁত শুধু পরস্পরকে আঘাতই করতে পারে। কিছু ‘চিকেন হার্টেড’ (!) মানুষ ‘আত্মসন্মান বোধের’ অজুহাতে (!) শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দেন সন্তানদেরকে ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’র দায়ে ফেলে আর বেশীরভাগ রয়ে যান যুযুধান- কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান।
অবশ্য নারীদের বেশীরভাগই বিজিতের দলে। তাই বলে কি দলে দলে নারী অথবা পুরুষগণ রণে ভঙ্গ দিয়ে আলাদা হয়ে যাবে? মোটেও তা বলছি না। আসলে আমাদের দেশে বিয়েটা এখনো একটি নারীর সাথে পুরো একটি পরিবারের। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নুতন বিয়ে হয়ে আসা মেয়েটি প্রথম দিনেই আবিষ্কার করে সে যদিও ভালবেসেছে পুরুষটিকে, কিন্তু বিয়ে সে করেছে ওই পরিবারের প্রথা, রীতি-নীতি, অভ্যাস ইত্যাদিকে। সেই খানেই মনে হয় সংঘর্ষের সূচনা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ের পরে প্রেমিক পুরুষটি তার পরিবারের সামাজিক রীতি’র ধারকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং এই পারিবারিক সামাজিকতার রীতি ইত্যাদি বহমান রাখার জন্য স্ত্রীর সময় এবং শক্তি ( টাইম এন্ড এনার্জি) কোরবানি দিতে হয়। এখনো কত মেয়েকে বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। অনেক কয়টি মেয়েকে জানি, বাপের বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখাটাও স্বামীর মর্জির উপরে নির্ভরশীল। একজনকে জানি, বড় চাকরি করে মেয়েটি, ভাল মাইনা পায়, নিজের অসুস্থ মাকে টাকা দিতে হলে স্বামীর অনুমতি ছাড়া দিতে পারে না। অবশ্য উলটোটাও যে নাই, তা নয়।
অনেক সমাজবিজ্ঞানী বলে থাকেন, ম্যারেজ কাউন্সেলরের প্রচলন আমাদের দেশে নাই। বিদেশে আছে, এখানে থাকলে পরে অনেক ‘ভাঙ্গা পরিবারেরই হয়তো ‘আস্ত’ থাকার সম্ভাবনা ছিল। আসলে ম্যারেজ কাউন্সেলর নয়, দরকার আমাদের নিজেদের মনের পরিধি বাড়ানো। যে মানুষটির সাথে সারা জীবন একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করা হয়, সেই মানুষটির গুনগুলোর সাথে সাথে দোষগুলোও মেনে নেয়ার উদারতা- পুরুষ নারী উভয়ের জন্যই সমান দরকার। সব চেয়ে বড় দরকার একজন আরেকজনের জীবনের ‘ইনডিভিজুয়াল স্পেস’ কথাটি বোঝা!
যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি মনে হয়। বলছিলাম ‘ব্রোকেন ফামিলি’র কথা। সেই সব পরিবারের সন্তানদের কথা। আমার বন্ধু, সিঙ্গল প্যারেন্ট সে। তার সন্তানের স্কুলে অনুষ্ঠান। পিতামাতা উভয়কেই যেতে হবে। গেল তারা উভয়েই, বসতে হলো নির্ধারিত আসনে।
তাদের পাশেই আরেকটি পরিবার। পরিচিত। ভাঙ্গা নয়, আস্ত পরিবার। আমার বন্ধুটি তার প্রাক্তন স্পাউজের পাশে বসে দু-একটি সামাজিক কথা বলে চুপচাপ অনুষ্ঠান দেখতে থাকল। পাশে বসা পরিবারের বাবা-মা সারাটা সময় কথা কাটাকাটি করে কাটালেন- কি নেই সেই হিংস্র সাপের মতন হিস হিসে ঝগড়ায়-স্ত্রী একাই এই অনুষ্ঠানে আসতে পারতেন, স্বামীকে শুধু শুধু ছুটির দিনের ঘুম ভাঙ্গিয়ে সাত সকালে টেনে আনা, আরও পরে এলেও চলতো, বাবাটি কোনদিনও কোচিং সেন্টার ও দূরের কথা পরীক্ষার সময়ও সন্তানকে সময় দেয় নাই, সন্তানের এই ভাল রেজাল্ট এর পরেও স্ত্রীর বাপের বাড়ির কিপটেমি থেকে শুরু করে স্বামীর বোনের অত্যধিক খবরদারির কারণে বিপর্যস্ত স্ত্রীর জীবন, শেষ হলো গিয়ে অন্য কোন নারীর সাথে স্বামীর মাখামাখির বিষয়ে। প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে আমার বন্ধুটি কান পেতেই শুনল পুরো সময়। অনুষ্ঠানের শেষে, যখন সামাজিকতার পালা, তখন তাদের যুগল হাসিমুখ দেখে কে বলবে পাঁচ মিনিট আগ পর্যন্ত তারা একজন আরেকজনকে ছোবল মারছিলেন।
অবশ্য তখনো মোক্ষম ধাক্কাটি আমার বন্ধুর জন্য তোলা ছিল, প্রথামাফিক ছবি তোলা, একজন আরেকজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি হয়ে যাওয়ার পরে বন্ধুটি যখন সন্তানের হাত ধরে পা বাড়িয়েছে চলে আসার জন্য, শুনল তার পিছনে, হিসহিসে নয় ফোঁস ফোঁসে স্বর,’ আহারে বাচ্চাটা ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’র!”