দেশপ্রেম এবং আমার বিক্ষিপ্ত ভাবনা

Anthem
সোহরাউয়ার্দী উদ্যানে ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের মূহূর্ত

লীনা হক: গত বছর ( ২০১৩) ১৬ই ডিসেম্বরের দিন আমার মেয়েটি গিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সবার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে। আমি সেই অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি নানাবিধ কারণে। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া শেষ হলে মেয়ে ফোন করল- আবেগে উদ্বেলিত তার গলা, ‘ মা, এরকম আর কখনো লাগেনি। কেমন যেন লাগছে! কান্না কান্না লাগছে!’ তখনও গলা কাঁপছে তার।

আমার মনে পড়ে গেলো নেদারল্যান্ডসে পড়াকালীন যেকোনো অনুষ্ঠানে আমি একটা সবুজ জমিন লাল পাড় জামদানি পরে যেতাম আর যেকোনো সুযোগে হেঁড়ে গলায় প্রথমে ‘ও আমার দেশের মাটি’ তারপরে ‘সকল দেশের সেরা’ আর শেষে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতাম। যখন আমি গাইতাম ‘আমার সোনার বাংলা’ – সহপাঠী, বন্ধু আর শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে যেতেন কারণ তিন মাসের মধ্যে সবাই জেনে গিয়েছিল আমি তৃতীয় যে গানটি গাই তা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। অনেকেই ঠাট্টা করতো কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দিকে কেউ কেউ গাইতেও শিখে গিয়েছিল।

মনে পড়ে, প্রতিবার জাতীয় সঙ্গীত গাইবার সময় বুক মুচড়ে উঠত, চশমার আড়ালে লুকোতে চাইতাম জলে ভরা চোখ আর বন্ধু এগনেস পিছনে দাঁড়িয়ে পিঠে মমতাভরা হাত রাখত। কিন্তু শুধু জামদানী পড়ে আর জাতীয় সঙ্গীত গেয়েই প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রী আনা যায় নাই। আমাকে পড়তে হয়েছে দিন রাত, সকাল দুপুর, ছুটির দিনে, দেশে থাকা সন্তানের কথা মনে করে চোখের জলে ভেসেছি সামনে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েও।

আমি জানতাম, এই যে সবাই আমার জাতীয় সঙ্গীতের সময় দাঁড়িয়ে যায় এ শুধু নিছক ভদ্রতা নয়। এটা আমার পরিশ্রমের প্রতি সন্মান, আমার ত্যাগের প্রতি সন্মান, আমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর অবিচলতার প্রতি সন্মান। আমি সবসময় একটা ছোট জাতীয় পতাকা রাখি আমার স্যুটকেসে, যখনি বিদেশে যাই। এটা দেখাবার জন্য নয়, আমার নিজের জন্য, নিজের ভিতরের শক্তি, প্রত্যয়কে জাগিয়ে তোলবার জন্য যে আমি যেন আমার কোন কাজের মাধ্যমেই আমার দেশের নাম অবহেলার সাথে উচ্চারণ করার সুযোগ করে না দেই। যাই হোক, সেই রাতে বাড়ী ফেরার পরে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়ের মুখে শুধু সবাই একত্রে জাতীয় সংগীত গাওয়ার গল্প।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘গাইতে গাইতে কান্না পাচ্ছিল যখন তখন কি করলে?’ মেয়ে উত্তর দিল, ‘প্রথমে কান্না চাপার চেষ্টা করছিলাম, পরে দেখি সবার চোখে জল, তখন আমিও আর চোখের জল লুকোবার চেষ্টা করিনি। অনেক জন মুক্তিযোদ্ধা সমানে কাঁদলেন গাইতে গাইতে। জানো মা, কেমন জানি কষ্ট মতন হচ্ছিল, আবার অন্য রকম ভালো লাগছিল’।

জানতে চাইলাম অন্য রকম ভালো লাগাটা কেমন? মেয়ে হেসে বলল, ‘বুকের ভেতরে কেমন যেন করছিল মা, বোঝাতে পারছি না। কেমন যেন গর্ব গর্ব লাগছিলো। আমি বড় হয়ে পড়ালেখা শেষ করে দেশের জন্য কাজ করবো। যেমন ভাই করছে, যেমন সবাই ভাইকে ডাকে ‘ বাংলাদেশের হীরে’ বলে।“ মেয়ের ঝকঝকে প্রত্যয়ী চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের গভীরে নুতন করে জেনেছিলাম জয় আমাদেরই, জয় সত্যের, জয় মানবতার, জয় দেশপ্রেমের, জয় বাংলাদেশের! পৃথিবীর কোন শক্তি রুখতে পারবে না এই নুতন বাংলাদেশের জয়যাত্রা!

কিন্তু গত ২৬ শে মার্চ, প্যারেড গ্রাউনডে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিয়ে এতো তর্ক-বিতর্ক – কেমন যেন পুরো ব্যাপারটার উপরে কালি ঢেলে দিয়েছে। কি সত্যি, আর কি সত্যি নয় তা আমাদের মতন সাধারণ মানুষ জানে না, জানতেও চায় না। ঘটনা যাই হয়ে থাকুক না কেন, কেন হবে? দেশের প্রতি ভালবাসা দেখাতে গিয়ে মানুষের প্রতি অশালীন আচরণ তো দেশপ্রেম নয়। মানুষই তো দেশ। মানুষকে কষ্ট দিলে দেশের জন্য কি ভালো আমি করতে পারবো?

আবার গত কদিন ধরে চলছে একজন পর্বতারোহী ‘ মাউন্ট এভারেস্ট’ এর চূড়োয় সত্যি সত্যি উঠেছেন কি, উঠেন নাই সেই তর্ক। যুক্তি পাল্টা যুক্তি- খবরের কাগজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশনের পর্দা সবখানে একই কথা। সকল পর্বতারোহীই কিন্তু চূড়োয় উঠে বাংলাদেশের পতাকা স্থাপন করেন সেখানে। দু এক লাইন জাতীয় সঙ্গীতও কি গেয়ে ওঠেন না! পৃথিবীর সামনে নিজেদেরকে ছোট করার এই চলমান তর্কে যারা অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা কি আমার চেয়ে কম দেশপ্রেমিক!

Leena Haq
লীনা হক

কে আগে উঠেছেন আর কে পরে তার চাইতে বড় কি এই সত্য নয় যে বাংলাদেশ ২০১০ সালে প্রথম এভারেস্ট পর্বতের চূড়োয় তার লাল সবুজ পতাকা দুলিয়েছিল? নিজের দেশকে বাইরের পৃথিবীর সামনে খাটো করা কি দেশ প্রেমের সংজ্ঞায় পড়ে? আমি জানি না। একবার তো বাংলাদেশের নাগরিকের নোবেল প্রাইজ পাওয়া প্রসঙ্গে উপর দিকে থুথু ছুঁড়ে নিজের বুকে সেই থুথু পড়ার চূড়ান্ত নজির আমরা দেখিয়েছি।

কেন আমরা এই সবের মধ্যে এতো মূল্যবান সময়, টাকা পয়সা খরচ করছি? কার স্বার্থ উদ্ধার হচ্ছে জানি না। তবে দেশপ্রেম যে প্রকাশ পাচ্ছে না এটা আমার মনে হচ্ছে। তবে এটাও সত্যি, আমার মতন নাদান বেয়াক্কেলে পিছনের সারির মানুষের ভাবনায় না দেশের কিছু আসে যায়, না দেশ প্রেমিকদের!

শেয়ার করুন: