উইমেন চ্যাপ্টার: এই লেখার ১২ সংখ্যায় পুরুষদের একলা থাকার বিষয়টি বলা হয়েছিল একটু খানি। এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়া পুরুষটি অবশ্যই বহির্গামী হয়েছেন বলেই ধরে নেয়া হয়। হয়তো প্রাকৃতিক ভাবে পুরুষদের বহুগামী চরিত্রের কারণেই এমনটি ভাবা। গাছের খাওয়া আর তলার কুড়োনো পুরুষের চরিত্রের ভিত্তি। সন্তানের দায়িত্ব না নেয়া পুরুষের অতি সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাস্তবে সবক্ষেত্রেই হয়তো তা নয়।
একজনকে জানি, ভালবেসে বিয়ে করেছিল, আট বছরের প্রেম| পরিবারের শক্ত আপত্তি থাকার পরেও বাবা মাকে বুঝিয়ে নিজের ভালবাসার মেয়েকেই বিয়ে করে। কারণ মেয়েটিকে ভালবাসার সাথে সাথে মানুষ হিসেবে ওই মেয়েটির আত্মসম্মানের প্রতিও তার শ্রদ্ধাবোধ ছিল, আর ছিল নিজের কমিটমেনটের অবিচলতা। পরিবারের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে বিয়ে না হলে এর চাইতে অসম্মানজনক আর কি হবে। লেখালেখির সাথে জড়িত অত্যন্ত সৃজনশীল মনোভাবের এই মেয়েটি বিয়ের পর পরই প্রকাশ পেলো তার সন্দেহ বাতিকগ্রস্ততা। যেকোনো মেয়েকে নিয়েই স্বামীকে সন্দেহ করে সে। ছেলেটির বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট থেকে শুরু করে খালাত চাচাতো বোন, সহকর্মী বা কাজের মেয়ে কেউই বাদ যায় না। তাদের বাসায় ছেলেটির কোন নারী সহকর্মী আসতে পারবে না, কাউকে নিমন্ত্রণ করা যাবে না, কাজিন বোনরা কখনো চলে এলে, ছেলেটির হেনস্থার শেষ নাই।
ডাক্তার দেখাতে চেয়েছিল স্বামীটি, উল্টে আরও বিশাল ঝগড়া। এভাবেই ১৫ টি বছর পার করেছে তারা। এরই মধ্যে দুটি সন্তান এসেছে জীবনে। এই সন্দেহগ্রস্ততার জের ধরে নানা ঘটনার সূত্রপাত। স্ত্রীর এই বাতিকের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে স্বামীকে ফলো করা, টেলিফোনে আড়ি পাতা, স্বামীর অফিসে নালিশ করা ইত্যাদির মাধ্যমে। পারিবারিকভাবেও নানা ধরনের সামাজিক হেনস্থার অবস্থা তৈরি হয় পুরুষটির জন্য। নিজের পরিবারের বাইরে প্রায় সবাই পুরুষটিকেই দোষারোপ করে, সেই দোষী। এই অবস্থায় ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল পুরুষটি, মা বুঝিয়েছেন, তোমার সন্তানদের কি হবে? তোমার বাবার সম্মানের হানি হবে।
পারিবারিক সম্মানের দায় শুধু মেয়েদেরকে নয়, ছেলেদেরকেও নিতে হয়। স্ত্রী হুমকি দিয়েছে, ডিভোর্স দিতে চাইলে নিজের গায়ে নিজে আগুন লাগিয়ে শুধু স্বামীটিকেই নয়, পুরো পরিবারকে জেলে ঢোকাবে। কারণে- অকারণে স্ত্রীর তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে জর্জরিত সে অফিসের পরে বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরে আবদ্ধ থাকে। আজ প্রায় ৫ বছর দাম্পত্য ব্যাপারটিও আর তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নাই। এক ছাদের নীচে আলাদা ঘরে থাকে তারা। প্রায়ই পালিয়ে যেতে চায় সে জীবন থেকে। প্রতি রাতে ঘুমন্ত সন্তানের নিস্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে এই অকার্যকর সম্পর্ককে টেনে চলে সে।
আসলে নারী পুরুষের সম্পর্কের মূল ভিত্তি – আস্থা আর ব্যক্তি মানুষ হিসেবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা বোধ। স্বামী স্ত্রী দুজনের প্রতি দুজনেরই যদি অনুভব না থাকে সেই সম্পর্কের পরিণতি হয় বিচ্ছিন্নতা – পুরোপুরি অথবা এক বাড়ীতে আলাদা থাকা।
অনেকসময়ই মনে হয় আমাদের সমাজে স্বামী বা স্ত্রী- এই শব্দ দুটির প্রতিশব্দ ‘ ক্রীতদাস’। বিয়ের সার্টিফিকেটে সাইন করাতো নয়, যেন দাসখত লিখে দেয়া। নারীই বেশী ভুক্তভোগী এই ক্ষেত্রে। আমার কাছে মনে হয়, আসলে আমরা, জাতি হিসেবেই হয়তো অন্য ব্যক্তির নিজস্বতা, ইরেজিতে যাকে বলে own individual space এ বিশ্বাসী নই, সেটাই একটা অন্যতম কারণ সম্পর্কের মধ্যে এই ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার।
আমার সাথে চাকরি করতো আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। ছাত্র জীবনে অত্যন্ত হাসি-খুশি প্রাণবন্ত এই বন্ধুটি সব সময় কেমন যেন ম্রিয়মান। ওর স্ত্রী আর দুটি মেয়ে। জানলাম, সাধারণ কৃষক পরিবারের এই মেধাবী ছেলেটি বিয়ে করেছে ঢাকা শহরের বিত্তশালী ব্যবসায়ীর মেয়েকে। নিজের মা আর বিধবা বোনকে নিজের কাছে এনে রাখা তো দূরের কথা, মাসের শেষে তাদেরকে টাকা পাঠাতে হলেও স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া পারে না। সন্তানহীন বিধবা বড় বোনটি নিজের গহনা আর জমি বিক্রি করে ছোটভাইকে পড়া লেখা করিয়েছেন। বন্ধুটি মা-বোনকে ঢাকায় এনে আলাদা বাড়ীতে রাখতে চেয়েছিল মায়ের চোখের অপারেশন আর বোনের চিকিৎসা করাতে। স্ত্রী বলেছে, মায়ের বয়স যেহেতু ৭০ এর বেশী, এখন আর শুধু শুধু টাকা খরচ করে লাভ কি! আমার বন্ধুটিকে ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলে ধিক্কার দিলাম যে সে কেন এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসছে না! কিন্তু সত্যিটা হলো যে, সন্তানের জন্য শুধু মা নয়, বাবাও নিজের জীবন পাঁকে পুতে ফেলে। বন্ধুটির স্ত্রী ভয় দেখিয়েছে, ডিভোর্স করতে চাইলে নারী নির্যাতনের মামলা করবে সে এবং মেয়ে দুটিকে দেবে না! কন্যা অন্ত প্রাণ আমার বন্ধু, অসহনীয় এই জীবনের ভার একাকী বহন করে চলেছে।
এটা ঠিক যে মেয়েদের একাকী অসহায়ত্বে সামাজিক এক ধরনের আরোপিত গ্লানি থাকে, পুরুষদের জন্য আবার থাকে ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টি। ধরেই নেয়া হয়, সেই পুরুষটি অবশ্যই অন্য নারীতে আসক্ত হওয়ার কারণেই স্ত্রী এই ব্যবহার করছে। আবার এটাও এই সমাজ ভাবতে চায় না যে, পুরুষও মানসিক ভাবে পীড়নের শিকার হতে পারে।
আসলে নারী বা পুরুষ উভয়কেই শুধু ভাবলে হবে না বিশ্বাসও করতে হবে যে– স্ত্রীটি বা স্বামীটি তার স্থাবর সম্পত্তি নয়। বরং ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর আস্থার মিলনে এই সম্পর্কটি হয়ে উঠতে পারে পরস্পরের জীবনে সম্পদ। আরেক জনকে জানি, পা তাঁর ফসকেছিল মুহূর্তের দুর্বলতায়, স্ত্রীর কাছে নিজে থেকেই স্বীকার করেছিলেন সেই কথা, দুর্ভাগ্য, স্ত্রী সেই স্বীকারোক্তিকে সহজভাবে নিতে পারেন নাই। তৈরি হলো, সামাজিক হেনস্থা ওই পুরুষটির জন্য। আজ ১৬ বছরেরও বেশী সময় এক বাড়ীতে আলাদা তাঁরা। কারণ ওই একই- সন্তান।
বুক ভেঙ্গে যাওয়া কষ্ট সত্বেও ওই কঠিন অপ্রিয় সত্যটি যদি স্ত্রী ভুল হিসাবেই নিতেন এবং সালিশ বৈঠক না করতেন, সম্পর্কটি বেঁচে থাকতো। আজ যখন তাঁরা পিছনে তাকান, স্ত্রীটি আফসোস করেন, শতকরা ১০০ জন মানুষ ( পুরুষ নারী নির্বিশেষে) নিজের ভুলের কথা স্বীকার করেন না। কিন্তু ওই সময়ে মাথা গরম করে চারিদিকে জানান দিয়ে তিনি ঠিক করেন নাই। পুরুষটি নিজের সামাজিক অপমানের কথা ভুলতে পারেন না, স্ত্রীর জন্যও তা সমানভাবেই প্রযোজ্য, অথচ নিজেরাই কথা বলে ব্যাপারটি সমাধা করতে পারতেন।
স্ত্রী’টির বেদনা কি তাতে কমত? মোটেও নয়, কিন্তু আজ এই পর্যন্ত যে সামাজিক ব্যঙ্গ সহ্য করে এসেছেন তা থেকে রেহাই পেতে পারতেন। কাগজে-কলমে আলাদা তো হতে পারেননি কেউই তাঁরা।
আসলে ছোট ছোট ভুলে বা বড় ভুলেও নিজেরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে কিভাবে পরস্পরকে সাহায্য করা যায় সেই চেষ্টা না থাকলে সম্পর্ক শেষ হতে সময় লাগে না। তখন শুরু হয়, এক সাথে থেকেও একা থাকা অথবা আক্ষরিক অর্থেই একা থাকা। আর একা থাকার যে কষ্ট- হোক সে এক ছাদের নীচে থেকে একাকী জীবন যাপন অথবা সত্যিই একা থাকা, যে এই কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করে সেই জানে। বুঝিবে সে কিসে, কভু আশি বিষে দংশেনি যারে! (চলবে)