আমরা যারা একলা থাকি-১২

imp 1উইমেন চ্যাপ্টার: এই লেখার ১১তম সংখ্যাতেই বলেছিলাম, একা থাকার বিষয়টি একচেটিয়া মেয়েদের নয়, পুরুষরাও মাঝে মাঝে একা থাকে। তবে তাদের একা থাকার ধরনটা হয়তো হয় আলাদা রকমের।

মেয়েদের একাকীত্বে যেমন একটা আরোপিত গ্লানি থাকে, সমাজের সমালোচনা থাকে, ভ্রুকুটি থাকে, ঠিক ততোটাই সহানুভূতি থাকে একা পুরুষদের প্রতি। আর তাই স্ত্রী মারা যাওয়ার ৪০ দিন না পেরোতেই বাড়ির লোকজন দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। সেই সংসারে যদি সন্তান থাকে, তাহলেও বলা হয়, ‘আহারে, ছেলেমেয়েগুলোকে কি করে বড় করবে সে’! তাই তখন আঁটঘাট বেঁধে পরিবারের সবাই লেগে যান পাত্রী খুঁজতে। মা-হারা ছেলেমেয়েদের মন থেকে মায়ের জন্য কষ্টের দাগ মুছে যাওয়ার আগেই ঘরে আসে ‘নতুন মা’, যে মা কদাচিৎ তাদের ‘মা’ হয়ে উঠে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় না। শুরু হয় অন্য এক যন্ত্রণার জীবন। অবশেষে সেই ছেলেমেয়েদের জায়গা হয় পিতৃকুল-মাতৃকুলের বাড়িতে।  বড় হয় অবহেলা-অনাদরে। আর ওদের বাবা তখন মহাসুখে সংসার গড়ে নতুন জীবনে।

কিন্তু একজন স্বামীহারা নারীর প্রতি সমাজ কিন্তু একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সন্তান পালনের সব দায়িত্ব প্রাকৃতিক নিয়মেই যেন মায়ের ওপর পড়ে, তাই তার দ্বিতীয় সংসারের স্বপ্ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বপ্নই থেকে যায়। তাছাড়া এই সমাজে সন্তানসহ নারীকে বিয়ে করার মানসিকতা কম পুরুষেরই থাকে, পরিবার তো আরও দূরের বিষয়। কদাচিৎ হলেও সেখানে নানান ঝামেলা লেগেই থাকে। এক বন্ধু বিয়ে করেছিলেন দুই সন্তানসহ একজনকে। তাদের ঘরেও আরেকটি ছেলে হয়। ওই বন্ধু বলছিলেন, খুবই সুখী তারা। কেবল তার মা যখন ফোন করেন, তখন জিজ্ঞাসা করেন, আমাদের বাবুটি কেমন আছে? উনি জানতে চান না, অন্য দুটি বাচ্চা কেমন আছে। এ নিয়ে প্রায়ই মন খারাপ হয় ওই বন্ধুর স্ত্রীর। তাই তাকে শ্বাশুড়ির মন জোগাতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে বন্ধুটির স্ত্রী বলা যায়, সফল। সে পেরেছে তার বাচ্চাদেরও এই পরিবারের অন্যতম অংশীদার হিসেবে ঠাঁই দিতে। অবশ্য অনেকেই বলেন, স্ত্রীর বাবার বাড়ির অর্থ-সম্পদও এক্ষেত্রে অনেকটা জাদুর মতোন কাজ করেছে। তার মানে, যে স্ত্রীর সম্পদ নেই, তার জন্য নিজের জায়গা করে নেওয়াটা খুব সহজ হয় না।

তবে এখানেও যে ব্যতিক্রম নেই, তা নয়। আমার জানা এক দুলাভাই ছিলেন (এখন নেই), যিনি স্ত্রী চলে যাওয়ার পরও শ্বশুরবাড়িতে থেকে চারটি সন্তানকে বড় করেছেন, শ্যালক-শালিকাদের আপন ভাইবোনের মতোন মানুষ করেছেন, জায়গা করে নিয়েছিলেন বড় ভাইয়ের।

আবার প্রবাসী একজনকে চিনি, যিনি স্ত্রীর সমস্ত তাচ্ছিল্য-অবহেলা সত্ত্বেও একই বাড়িতে ১০ বছর ধরে আছেন শুধুমাত্র মেয়ের মুখটি প্রতিদিন দেখবেন বলে, মেয়ের হাঁটার শব্দ পাবেন বলে। মায়ের ভয়ে মেয়েটিও তার সাথে দেখা করে গোপনে, ইশারায়-ইঙ্গিতে। সেই ব্যক্তির মুখেই শুনেছি, মেয়েটি যখন ছোট, তখন দরজায় এসে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখাতো, তাকে যেন একটু জড়িয়ে ধরে আদর করে দেয় বাবা। এটা হতো ইশারায়, অঙ্গভঙ্গিতে। আর এইটুকুর বিনিময়ে ওই লোককে প্রতিদিন দেয়ালের ওপাশ থেকে শুনতে হয় নানান বাজে উক্তি। জিজ্ঞাসা করি, তারপরও থাকেন? চোখ ছলছল করে উঠে ভদ্রলোকের। উনি ক্ষমা করতে পারেন না যে, ছেলেমেয়ের বড় হওয়াটা তিনি উপভোগ করতে পারেননি একই ছাদের নিচে থেকেও। স্ত্রী ক্রমাগত ডিভোর্সের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কাগজপত্রের জটিলতায় তা আর হয়ে উঠছে না। এবার স্ত্রী নিজেই এসে ওই ভদ্রলোকের সাহায্য চেয়েছেন ডিভোর্সের ব্যাপারে।

জটিল সমীকরণ শুরু হয় ভদ্রলোকের জীবনে। এতোদিন তিনি এতোকিছুর পরও অপেক্ষায় ছিলেন সংসার জোড়া লাগবে এই আশায়। শেষরক্ষা বুঝি আর হয় না। জীবনের একটা বড় সময়ও চলে গেছে এরই মধ্যে, এখন স্বপ্ন দেখছেন নতুন করে জীবন শুরু করার। কিন্তু এটাও ভাবেন যে, শোনার পর মেয়েটি তার কষ্ট পাবে। বড় বিচিত্র এই জীবন! কখনও ভাঙে, কখনও গড়ে, কখনও হাসায়, কখনও কাঁদায়। কে জানে এর শেষ কোথায়? কিভাবেই বা?

প্রেম করেই বিয়ে করেছিলেন অনুপম। বলা যায়, সংসারে নিয়ম ফিরিয়ে আনতে চাকরীজীবী মা-ই তাকে বিয়ে করিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর বেকার অনুপমের ঘাড়ে চাপে স্ত্রীর ভাইবোনদের দায়িত্ব। অনুপমের মা সব সয়ে নেন ছেলের মুখের দিকে চেয়ে। একদিন অনুপমকে বলতে শুনি, ‘বিয়ে তো একজনকে করিনি, করেছি গোটা পরিবারকে’। সেই বলায় খেদ ছিল, কষ্ট ছিল। বছরে আটমাসই দেখা যেতো স্ত্রীর সাথে অনুপমের খিটিমিটি লেগেই আছে। যে অনুপমকে ঘরে ফেরাতে মা বিয়ে করিয়েছিলেন, সেই আজ তুমুল উদ্দীপনার সাথে আরও বেশি সংসার বিমুখ হয়ে পড়ে, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পড়ে থাকে তাসের নেশায়। তাকে টেনে আনা যায় না। নতুন বউ ঘরে একা পড়ে থাকে। কী দ্বৈরথ চলে তাদের জীবনে!

একাকীত্বের কথা বললেই কিছু মানুষ মুখিয়ে উঠে বলে, আসলে সবাই একা, নিজের মতো করে একা। কেউ সংসারে সুখী হয়, কেউ হয় না। যারা হয় না, তারা সুখ খুঁজে নেয় নিজের মতো, কখনও নিজেকে উজাড় করে দিয়ে, কখনও বা কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে। কদাচিৎ মেলে মনের মতো কাউকে, যাকে ভালবাসা যায়, যাকে বন্ধু ভাবা যায়, যাকে নিয়ে পাড়ি দেওয়া যায় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনসমুদ্র। আসলে যে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে না গেছে, সে কখনই বুঝবে না, কী তার কষ্ট! (চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.