ফারহানা আনন্দময়ী: মানচিত্রের কাঁটাতার কেবল মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করে। আত্মার অধিকার বোধহয় সংরক্ষণ করতে পারে না।
হাতের কাছে পাই না, কোলের কাছে পাই না… কিন্তু প্রতিনিয়ত বুকের কাছে কুলকুল বয়ে যায় কোপাই, খোঁয়াই।
কোলকাতার নাম বলতে গেলেই মুখে চলে আসে, আহা! প্রাণের কোলকাতা।
আমি জানি ঠিক একইরকম ভাবে আমার অনেক বাঙালি বন্ধু আছেন, যারা ওই বাংলায় বাস করেন… যাদের ভাবনার অলস মুহূর্তে একবারের জন্যেও ভাবনার গা ঘেষে বয়ে যায় সাঙ্গু নদী… কখনো বা কর্ণফুলি। বাংলাদেশের যে কোনো গৌরবেও যেমন তারা আনন্দিত হন, বাংলা মায়ের চোখের জলও তাদেরকে বিষন্ন করে।
তাই তো তারা বাংলাকে ভালবেসে, বাংলাদেশকে ভালবেসে গত কয়েকমাসের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উৎকন্ঠিত হয়ে নির্দ্বিধায় লিখতে পারেন…” বাংলাদেশ, যাকে আমার কলজের একটা টুকরো ব’লে ভাবি, সেখানে এতো মৃত্যু, জীবনের অপচয় খুব কষ্ট দিচ্ছে। আর ভয়ে সিঁটিয়ে আছি, সেসব ঘটনা এ দেশে মৌলবাদী সুপারম্যানদের হাত শক্ত করবে ব’লে।“ এই সহমর্মিতা জানানোর জন্য পাসপোর্ট, ভিসা লাগে না। আত্মার টানই যথেষ্ট।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ যখন উত্তাল… বাংলাদেশ তখন এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দিচ্ছে।
বর্ধমানের এক বন্ধু, মানব ব্যানার্জী তাঁর দরাজ গলায় গাইলেন…
“তুমি ওপারে ডাকো, সাড়া দেয় এপারে
নদী এপারে ভাঙে, চর গড়ে ওপারে।
খুলনা ঢাকা চট্টগ্রামে, বিক্রমপুরে বর্ধমানে
আমরা আছি, আমরা থাকি…
পায়ে পা মেলাই।
আমার ভাষা তোমার ভাষা
মারের বুকে বাঁচার আশা…”
প্রিয় কবি মিতুল’দি মায়াভরা কন্ঠে লিখলেন, গাইলেন,
“কান্না নয়, মোছ চোখের জল
জ্বাল রে জ্বাল বুকে দাবানল,
কান্না নয়, নয় ভাবনা আর
স্বপ্নে থাক যৌথ খামার
আয় শাহবাগের হাতে হাত মেলাই…
হাত বাড়াই, শুরু হোক লড়াই।“
এখানে সাভার ট্র্যাজেডি যখন হলো, প্রিয় বন্ধু অভিজিৎ, যে সবসময়ই সঙ্গে থাকে বাংলার, বাংলাদেশের…
লিখলো, “ভালবাসা শুধু জীবন দিয়ে মৃত্যুটাকে মাপা,
ভেজাল মেশানো পরিকল্পনাহীন বাড়ির নীচেই চাপা।
চেপে চেপে রাখা কষ্টগুলো মিডিয়া করছে কাভার
ভেজালের সাথে আরও কী ছিল, বার করে যেন সাভার।“

এভাবেই, কতভাবেই সঙ্গে ছিলেন অলোক’দা, শ্রেয়সী, অপর্ণা, নন্দিতা আরও কত বন্ধু।
শাহবাগ, ফেলানিকে বিষয় ক’রে কত নতুন গান নিয়ে কী দারুণ ভাবে ছিলেন কবীর সুমন…
এভাবেও সঙ্গে থাকা যায়।
তাঁর গানেই বলি,
“মানচিত্র পুড়ছে পুড়ুক, এই দাবানল পোড়াক চোখ…
আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক।“
একেই বুঝি বলে আত্মার অধিকার! দিল্লীতে যখন একজন নির্ভয়া নির্যাতিত হন, এখানে আমরাও কেমন প্রতিবাদী হয়ে উঠি, হৃদয় বিক্ষুব্ধ হয়। কাঁটাতারে একজন ফেলানি যখন ঝুলে থাকে, তোমরাও কেমন লজ্জিত, বিচলিত হয়ে উঠো। আমরা তোমরা, আমাদের তোমাদের, এপার ওপার সব মিলেমিশে এক হয়ে যায়। বাংলার সূত্র ধরে কত সহজেই আপন হয়ে উঠে, কত আন্তরিকতায় আপন ক’রে নিই দূরের মানুষগুলোকে।
নবনীতা দেবসেনের একটি লেখায় পড়েছিলাম, “বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিকতা প্রবাদপ্রতীম। সেই গল্প রূপকথার চেয়েও সুন্দর।“
প্রিয় উর্মিমালা’দি জানেন, ব্রততী’দি জানেন, কবি সুবোধ সরকার জানেন কিছুটা নিশ্চয়ই… এই চট্টগ্রামের মানুষের ভালবাসার উত্তাপের কথা। এই প্রিয় গুনী মানুষেরা যখন এসেছিলেন এখানে, তাঁরা ভালবাসার সেই উত্তাপে পোড়েন নি, শুধু উষ্ণতা পেয়েছিলেন সবটুকু।
মনে পড়ে শ্রাবণী সেন ভিজেছিলেন ভালবাসার অঝোর বৃষ্টিতে। শিল্পকলায় মুক্তমঞ্চে গান গাইতে বসেছেন, রাত খানিকটা গাঢ় হয়েছে। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ… হঠাৎ বেরসিক ঝড় আর বৃষ্টি বিনা খবরে হাজির। তাও বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মেখে কয়েকটা গান নিয়ে এগোলেন, এমনই ভালবাসা শ্রোতাদের, হারমোনিয়াম তবলা ভিজছে, তাও শ্রাবণী’দিকে মঞ্চ ছাড়তে দিবেন না। ভালবাসার এমন অপরূপ বৃষ্টি শ্রাবণী সেন আর কখনো দেখেন নি বোধ হয় আগে কোনোদিন। আর ঢাকায় যারা আসেন গান কবিতা নিয়ে, আমার বিশ্বাস তারাও ফেরার সময় জামদানি শাড়ি, ইলিশ মাছের সাথে এরকমই অন্তরের উত্তাপ নিয়েই ফেরেন।
এও জানি বাংলাদেশ থেকে যে গুণীজনেরা যান ওখানে অনুষ্ঠান করতে, তারাও এভাবেই আত্মার মেলবন্ধনের অপূর্ব স্মৃতি নিয়েই দেশে ফেরেন। এই যে আত্মার টান, এই যে আন্তরিকতা… সেতো বৃথা যেতে পারে না। এর নিশ্চয়ই একটা মূল্যহীন মূল্য আছে। এক অসীম সাংস্কৃতিক ধন-ঐশ্বর্যের গর্বিত উত্তরাধিকার আমরা সমান ভাবে বয়ে চলেছি।
আজ এতো কথা বলার একটা বিশেষ কারণও আছে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সারা ভারতে ‘গুন্ডে’ নামে একটি হিন্দী সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
সিনেমাটির প্রথম ১১মিনিটে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করা হয়েছে।
ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম, ৩০ লক্ষ প্রাণের মহিমাময় আত্মদানকে এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে সেই মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয়েছে ১৩ দিনের ইন্দো-পাক যুদ্ধ! ক্ষমার অযোগ্য দুঃসাহস দেখিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বড়র বড়ত্ব সেইখানে, যখন সে নীচে তাকিয়ে ছোট’র হাত ধরতে পারে।
এগিয়ে চলতে সাহায্য করে।
হ্যা, আমরা কৃতজ্ঞ ভরে স্মরণ করি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেয়া ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য-সহযোগিতা, উদবাস্তুদেরকে দেয়া মমতাভরা আশ্রয়। সবই আমরা মনে রেখেছি।
আমরা আয়তনে ছোট দেশ হয়তো কিন্তু তার মানে এই নয়, যে আমরা সমর্পিত।
তীব্র প্রতিবাদ জানাই ‘গুন্ডে’র এই গুন্ডামির।
সুবন্ধু রীজু, আমি জানি বাংলাদেশের উপর আপনার আত্মার অধিকার।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি… আপনারও প্রাণের কাছেই বাজে অনুক্ষণ, অবিরাম।
বন্ধুতার দাবী নিয়ে বলবো, গুন্ডে সিনেমার এই অন্যায়ভাবে ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদ ক’রে একটি লেখা আপনি লিখবেন।
আপনার লেখার এমনই গুণ এবং আপনার সেই লেখার ভারত বাংলাদেশ মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক পাঠক আছে।
সিনেমাটি দেখে আপনি যদি এই বিষয়ে সত্যের পক্ষে কলম ধরেন…
আমাদের সহস্রজনের শত প্রতিবাদের চাইতেও সেই লেখা অনেক বেশি শক্তি ধারণ করবে।
জয় হোক বন্ধুতার, জয় হোক সত্যের।
(লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)