আমরা যারা একলা থাকি-১১

imp 1উইমেন চ্যাপ্টার: একলা থাকি প্রসঙ্গটা এলে সবাই ধরেই নেন যে, মেয়েদের কথা বলা হচ্ছে। যেন একলা থাকাটা কেবল মেয়েদের বেলায়ই প্রযোজ্য। আর বলা হয়ে থাকে ‘সিঙ্গেল মাদার’দের কথা। এই সিঙ্গেল মাদার শব্দটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। সিঙ্গেল আবার কী? একজন স্বামী নেই বলেই সন্তানসহ মা সিঙ্গেল হয়ে যাবে, এটা মানতে পারি না। তাছাড়া এই শব্দটার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য ভাব আছে। যা একজন নারীকে অপমান করে, অবদমিত করে। সিঙ্গেল শব্দটাকে বড়বেশি পুরুষতান্ত্রিক মনে হয়। এর মধ্য দিয়ে একজন মেয়েকে কোণঠাসা করে রাখার প্রয়াস চলে। আরও খোলাসা করে বলতে গেলে, সিঙ্গেল মাদার হচ্ছে একধরনের ‘সাইনবোর্ড’, অনেকটা গণমাধ্যমের বিতর্কিত ভাষায়, ‘তালাকপ্রাপ্তা’ নারীর মতোন।

গণমাধ্যমে যেমন প্রায়ই নিউজ হয়, তালাকপ্রাপ্তা নারী গণধর্ষণের শিকার। এতে একটা প্রচ্ছন্ন স্বীকারোক্তি থাকে যে, যেহেতু সে তালাকপ্রাপ্তা, তাই সে ধর্ষণের শিকার হতেই পারে। তালাকপ্রাপ্তা হওয়াটাই তার অপরাধ। অথচ আমরা খতিয়ে দেখি না, মেয়েটি তালাকপ্রাপ্তা? নাকি সে নিজেই তার স্বামীকে তালাক দিয়ে এসেছে? তারপর আসে আরও কিছু শব্দ। ফেসবুকের বন্ধুরা একটি নিউজ শেয়ার করেছে, যেখানে শিরোনামই হয়েছে এরকম, ‘পতিতা মেয়ে বারবনিতাকে বিয়ে করলো সমাজকর্মী’। শিরোনামটা পড়েই গা রি রি করে উঠলো। অনেকদিন ধরেই আমরা যারা নারী আন্দোলন নিয়ে কাজ করছি, তারা চেষ্টা করছি, সমাজের এক অংশের মেয়েদের নামের পাশ থেকে পতিতা শব্দটির তকমা সরিয়ে দিতে। বলছি যে, যে পুরুষ একটি বিশেষ এলাকার মেয়েদের কাছে যায় শরীরের উত্তেজনা কমাতে, সেই পুরুষ যদি ‘পতিত’ না হয় সমাজে, তাহলে শুধু সার্ভিস দেয়া মেয়েটি কেন ‘পতিতা’ হবে! আর বারবণিতা তো আরও অপমানজনক শব্দ। অথচ একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে নিজেদের আকৃষ্ট করার জন্য কেমন দিব্যি ছেড়ে দিল নিউজটা, যে সাংবাদিক নিউজটা করেছেন, তার ন্যুনতম জ্ঞানও নেই সাংবাদিকতা সম্পর্কে। এরকম টক-মিষ্টি-ঝাল নিউজ ছাপিয়ে অনেক অনলাইনই পাঠক বাড়ানোর উদ্দেশ্যে একটা নোংরা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে।

এই অনলাইনগুলোকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলে, সরকার এককাঠি সরেস হয়ে পুরো অনলাইনের ওপর এমন নিয়ন্ত্রণ বসিয়ে দেবে যে, তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে। তাই এটা বলা যাচ্ছে না, তবে অনলাইনের নামে যে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে। তবে কঠোর না হলেও সাংবাদিকতার ন্যুনতম মানদণ্ড বজায় রাখতে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত বলে আমার ধারণা। নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বাঙালী সহজভাবে নিতে পারে না বিষয়টা।

বলছিলাম একা থাকার কথা। একা থাকাটা মোটেও লজ্জাজনক বা অসম্মানের নয় এই সময়ে। বরং যুগে যুগেই মেয়েরা একা পথ চলেছে, এরকম দৃষ্টান্ত বহু আছে, সেই পথ যতো বন্ধুরই হোক না কেন, সমস্ত দায়-দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পথ চলতে পারার যোগ্যতাই এ ধরনের মানুষের অন্যতম পাথেয়।

কেন মানুষ একা হয়ে যায়? কখন হয়? আর একা হলেই কি একটি মেয়ে সব দোষের দোষী হয়ে যায়? অনেকগুলো কারণেই মেয়েরা আজকাল একা হয়ে যাচ্ছে। যৌথ সংসারে একটা মেয়ের আত্মসম্মানবোধ যখন ভূলুণ্ঠিত হয়, তখনই সে নি:শ্বাস ফেলার খোলা মাঠ খুঁজে। মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হওয়াটা এই খোঁজার প্রক্রিয়াকে সহজতর করে দিয়েছে। দিন দিন যে হারে অস্থিরতা বাড়ছে সমাজে, তারই প্রথম বলি হচ্ছে নারী। এতে করে ভারসাম্য হারাচ্ছে সমাজ, একথা আর অস্বীকার করার উপায় নেই।

কাজেই জীবনের কোনো একটা মূহূর্তে এসে যদি একজন মেয়েকে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, তাকে সেই সম্মানটুকু জানানোর মতোন সৎ সাহস অর্জন করতে হবে সবাইকেই। পাশে থেকে মানসিক সহায়তা দিতে যদি নাও পারেন, পিছন থেকে অন্তত ছুরিটুকু চালাবেন না দয়া করে। মনে রাখতে হবে, একজন মানুষ একটা আলাদা সত্ত্বা, তাকে সেইভাবেই বিচার করুন। জীবনটা অনেকটাই হালকা মনে হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.