টোনাটুনি-এক ভালবাসার গল্প

Love storyহাসান মাহমুদ: বহু বছর আগের কথা, ব্যতিব্যস্ত কাজ করছি আবুধাবী সেন্ট্রাল হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবের অফিসে – ল্যাবের ভেতর ব্যতিব্যস্ত আমার টেকনিশিয়ান টেকনোলজিস্টের দল।

ফোন বাজল, ওধারে মহিলা:

“হাসান মাহমুদ বলছেন?” “বলছি !” “একজনের কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বর পেয়েছি. আমাকে একটু হেল্প করতে হবে”।

হাসি পেল। হাসপাতালে সবাইকে কখনো না কখনো আসতেই হয়। আমার ওপরে আবুধাবীর পঁয়ত্রিশ হাজার বাংলাদেশীর অখণ্ড অধিকার, এ আমার লেগেই আছে। ছোটখাট আইনও ভাঙ্গতে হয় কখনো।

বললাম:- “বলুন!” “আমি পরশু ঢাকা থেকে এখানে ছেলের সংসারে এসেছি, – আগামী পরশু ফিরে যাব। এক পেশেন্টকে দেখতে চাই”. “চলে আসুন ভিজিটিং আওয়ারে, কোনো অসুবিধে নেই” “ভিজিটিং আওয়ারে না। আমি আসতে চাই যখন বাইরের কেউ থাকবে না”।

একটু ধাক্কা খেলাম। বললাম – “কোন পেশেন্ট”?

নাম শুনে চুপ হয়ে গেলাম। পেশেন্ট ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গভীর কোমা’তে লাইফ সাপোর্টে আছেন। জীবনের আর কোনো আশা নেই, ডাক্তারেরা জবাব দিয়ে দিয়েছে। এখানে তাঁর স্ত্রী সন্তানেরা আছে – এখন শুধু অপেক্ষা লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নেবার।

বললাম:

“উনি তো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছেন. ওখানে অনেক রেস্ট্রিকশন !!”

মিনতিভরা কন্ঠে তিনি বললেন – “দেখুন, উনাকে শুধু একটিবার দেখার জন্য আমি অর্ধেক পৃথিবী পাড়ি দিয়েছি। অফিস আমাকে ছুটি দিচ্ছিল না, রিজাইন করে এসেছি। প্লিজ, প্লি–জ একটা ব্যবস্থা করে দিন!!”

আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল – “চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন?” “কি করব – ছুটি দিচ্ছিল না। আমার এত বছরের চাকরি !”

মনে হল জীবনের এমন এক দাবি এসেছে, যাকে উপেক্ষা করা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়। বললাম-

“যখন বাইরের কেউ থাকবে না……তাহলে তো মাঝরাতে আসতে হয়”, “তাই আসব। আপনি থাকবেন, নাহলে আমাকে ঢুকতে দেবে না” “রাত দু’টোয় আসুন – আমি ইমার্জেন্সির গেটে থাকব। “আচ্ছা। আমি সবুজ শাড়ী পরে আসব, চিনতে পারবেন”।

রাত দু’টোয় তিনি ট্যাক্সি থেকে নামলেন, সবুজ শাড়ী পরা। আইসিইউ ওয়ার্ডে ঢুকতেই হাসিমুখে ছুটে এল হেড নার্স সুমাইয়া, বলল -“কি ব্যাপার, এত রাতে”? বললাম পেশেন্ট দেখতে এসেছি। সুমাইয়া মৃদু হেসে অন্যদিকে চলে গেল।

নাকেমুখে বিভিন্ন যন্ত্র থেকে লাগানো নানা রকম পাইপ আর টিউব, ধীরে বইছে নি:শ্বাস। চোখদুটো আগের মতই বন্ধ। সরু টিউবের ভেতর দিয়ে হাতের সুঁচে শরীরে ঢুকছে টিপিএন ফ্লুইড, টোটাল প্যারেন্টারেল নিউট্রিশন। আস্তে তিনি বসলেন বেডের পাশে চেয়ারে।

পেশেন্টের হাত ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন-

“টোনা ! আমি তোমার টুনি!! মনে আছে ছোটবেলার কথা?”

আমি বিস্ফারিত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি। এ শরীর এতদিন বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি শত আহ্বানে তার বন্ধু বান্ধবের, স্ত্রীর এমনকি সন্তানদেরও। সেটা এখনো পড়ে আছে একই রকম নিস্প্রাণ। ওই শরীর, ওই মন, ওই আত্মা কি আর কখনো কারো ডাকে সাড়া দেবে? তিনি ফিসফিস করে বললেন-

“তোমার অসুখের কথা শুনে ঢাকা থেকে তোমাকে দেখতে এসেছি!”

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি. আগের মতই কাঠ হয়ে পড়ে আছে পেশেন্ট। ওটা মৃত শরীরে জীবন্ত আত্মা নাকি জীবন্ত শরীরে মৃত আত্মা বলা কঠিন। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি ওই নিথর দেহের কোন অতলান্ত গভীরে নড়তে শুরু করেছে রহস্যময় বিশাল কি যেন। মহিলা গভীর মমতায় পেশেন্টের গালে নিজের গাল রাখলেন। আবার ফিসফিস করে বললেন –

“আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছ ! আমার কথা না শুনে তুমি পারবে না। সেই সবুজ শাড়ীটা তুলে রেখেছিলাম! এত বছর পর আজ আবার পরেছি!!”

অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। কোন সুদূর অতীত থেকে কত বছরের ক্ষুধার্ত বাল্যপ্রেম তীরবেগে ছুটে এসে বোমার মত বিস্ফোরিত হল হতচেতন দেহের ভেতরে। থরথর করে কেঁপে উঠল দেহ, নড়ে গেল নাক-মুখের পাইপ, হাতের সুঁচ নড়ে গিয়ে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত।

আতংকে চিৎকার করে উঠলাম- “সুমাইয়া !!!” ছুটে এল নার্সের দল কিন্তু সেই ভূমিকম্প থামায় কার সাধ্য। মহিলা ধরে আছেন তাঁর হাত, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,

“শান্ত হও, শান্ত হও টোনা! আমি তোমার পাশে এখনো আছি তো….আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাইনি….শান্ত হও….! ”

কি এক নিবিড় প্রশান্তিতে স্থির হয়ে এল দেহ, রুদ্ধশ্বাসে আমি তাকিয়ে আছি পাথরের মূর্তির মত। পেশেন্টের হাতের একটা আঙ্গুল একটু একটু নড়ছে. মহিলা অনেক আদরে সেই আঙ্গুলটা ছুঁয়ে রইলেন। যেন দুটো টোনাটুনি পাখী জীবনের শেষবার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কোন অজানা ভাষায় কথা বলছে। এদিকে নার্সের চোখে ফুটে উঠেছে মিনতি। মহিলা সেটা বুঝলেন। অচেতন রোগীর চোখে মুখে গালে কপালে বুকে ক্ষুধার্তের মতো হাত বুলোলেন, তারপর গভীর নি:শ্বাস ফেলে বললেন – “চলুন”

বাইরে ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। সে চোখে ফুটে উঠেছে অনুরোধ। আস্তে করে বললাম –

“কেউ জানবে না” মহিলা যেন নিজের মনে বললেন – “আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না”। তারপর একটু থেমে বললেন – “আপনাকে অনেক, অনেক ধন্যবাদ”

ট্যাক্সি চলে গেল।

আমি সম্মোহিতের মত, মূর্তির মত অপলক হতবাক দাঁড়িয়ে আছি সেই মরুভূমির মাঝরাতে।

পরদিন পেশেন্ট-এর লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.