দেশত্যাগের কথা ভাবছে সাতক্ষীরার অনেক হিন্দু পরিবার

Hindu 3উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক: সাতক্ষীরা জেলায় নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার শিকার হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু কিছু সদস্য দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে বলে বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়েছে। তবে পরবর্তীতে নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে এদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরলেও একটা বড় অ্ংশই এখনও সেখানে রয়ে গেছেন। অনেকে আবার ফিরবেন বলেও নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।

বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা আহরার হোসেন ঘটনাস্থল ঘুরে এসে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যেকোনও রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের ভারতে পাড়ি জমানো নতুন নয়। কিন্তু এবার সাতক্ষীরার সবচাইতে সহিংসতা বিক্ষুব্ধ আগরদাঁড়ি ইউনিয়নে এত মানুষ পাড়ি জমিয়েছে যার নজির বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আর দেখা যায়নি বলে সেখানকার লোকজন জানান।

উইমেন চ্যাপ্টারের পাঠকদের জন্য রিপোর্টটি  হুবহু তুলে ধরা হলো:

পায়ে চলা পথ ধরে এগিয়ে গ্রামের ভেতর বনেদী বাড়িটি দেখে থমকে দাঁড়াতে হলো। ঠিক তখনই একটি মোটরবাইকের পেছনে স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে বাড়িটির সামনে এসে থামলেন এক ব্যক্তি। মনে হলো বাইরে থেকে এসেছেন, জিজ্ঞেস করে জানা গেলো তাঁরা এই বাড়িরই বাসিন্দা।

তিনি জানালেন, জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর যে সহিংসতা শুরু হয়, তা দেখে তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপরই তারা ভারতে চলে যান।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এই পরিবারটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় সাতক্ষীরা জেলার আগরদাঁড়ি গ্রামের। গ্রামটি থেকে ভারতের সীমান্ত মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে।

এই গ্রামটি গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আলোচিত হয়ে আছে, আঠাশে ফেব্রুয়ারী জামায়াতে ইসলামী নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসির দন্ড দেবার পর থেকেই এখান পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে আছে।

এখানে দিনের পর দিন টানা অবরোধ চলেছে, অসংখ্য গাছ কেটে চলাচল বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, অনেক মানুষ নিহত হয়েছে। নির্যাতন, লুটপাট, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে গ্রামে থাকা হাজার খানেকের কিছু বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।

মাসের পর মাস এখানে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছাতে পারেনি, যা নতুন মাত্রা পেয়েছিলো গত ডিসেম্বর মাসে জামায়াতে ইসলামীর আরেক নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হবার পর। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে গত পনেরোই ডিসেম্বরের পর যখন পুরো সাতক্ষীরা জুড়ে যৌথ বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের পর থেকে।

মঙ্গলবার সকালে আমি যখন আগরাদাঁড়ি যাই, তখন সাতক্ষীরার স্থানীয় সাংবাদিকদের অনেকেই আমাকে বলছিলেন সাবধানে থাকতে।

সেখানে গিয়েও মানুষজনের মধ্যে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা দেখা গেছে।

আরেকটি বাড়ির দশ সদস্যের মধ্যে ছয়জনই ভারতে চলে গেছে এবং বাকিরাও যাই যাই করছে, এমন খবর পেয়ে সেই বাড়িটিতে গেলাম, বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি তারা কিছু না বললেও বাড়ীর বাকী সদস্যদের ভারতে থাকার কথা স্বীকার করেন গৃহকর্ত্রী।

আমার কথা হয় সুজয় কুমার বিশ্বাস নামে একজন কৃষকের সাথে, গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে শুধুমাত্র তাদের পাড়া থেকেই পনের-ষোলজন মানুষ ভারতে পাড়ি জমিয়েছে।

“আমাদের পাড়ায় হুমকি দিয়েছিল যে এখানে ভালো ভালো মেয়েছেলেরা আছে, পড়ালেখা করে। ওদের তুলে নিয়ে যাবে। একথা শুনে আমাদের এখান থেকে কিছু কিছু লোক তারা ভারতে চলে গেল। আমাদের এই সরকারি পাড়া থেকেই প্রায় পনের-ষোল জন এভাবে গেছে”।

আগরদাঁড়ি গ্রামেরই বাসিন্দা এবং সাতক্ষীরা জেলা আদালতের আইনজীবী শ্যামল কুমার বলছিলেন, গত এগারো মাসে তাদের গ্রামের যত লোক ভারতে চলে গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সব মিলে এত মানুষ তাদের গ্রাম ছাড়েনি।

“এমনি দু একটি পরিবার এর আগে ভারতে গেছে, কিন্তু সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু ২৮শে ফেব্রুয়ারির পর থেকে অনেকেই ভারতে গিয়ে থাকছে। সেখান থেকে ফিরবে কিনা একটা অনিশ্চিত অবস্থা। যারা আছে তারাও ভাবছে এখান থেকে চলে যাবে কিনা। বাবরি মসজিদের ঘটনার পরের দাঙ্গায়ও এখানে এরকম অবস্থা হয়নি”।

আগরদাঁড়ি গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক হিন্দু পরিবারের কর্তা গোপাল চন্দ্র আমাকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন গত বারোই ডিসেম্বর কিভাবে তাঁর দোতলা বাড়িতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই তিনি সাতক্ষীরা শহরে বাস করছেন পরিবার নিয়ে। মিস্টার চন্দ্র অবশ্য বলছিলেন তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা এবং এ কারনেই সম্ভবত তার উপর হামলা হয়েছে।

“কাদের মোল্লার রায়ের পর আমার বাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে আমাকে হতোদ্যম করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার ইচ্ছে নেই যে আমি আর এই বাড়ীতে আসি”।

মিস্টার চন্দ্রের মতো আগরদাঁড়ির হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে এখনো সাতক্ষীরা শহরে বসবাস করছেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ফেব্রুয়ারী মাসে সাতক্ষীরার আগরদাঁড়ি ও এর পার্শ্ববর্তী শিবপুর ইউনিয়নে যে সহিংসতা শুরু হয় তাতে সরকারী হিসেবেই এখন পর্যন্ত ৬ জন নিহত হয়েছে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন নিহতের সংখ্যা আরো বেশি হবে।

শেয়ার করুন: