আসুন, পতাকাকে অসম্মান না করি

Pataka 4সুপ্রীতি ধর: মাত্র দুদিন আগেই আমরা সর্ববৃহৎ মানব পতাকা বানিয়ে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছি, জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছি। এসবই আমাদের আবেগ, আমাদের অহংকার। সন্দেহ নেই, এতোসব ইতিহাসে শরীক হতে পেরে নিজেকে ভীষণ ধন্য মনে হচ্ছে। এটাও মনে হচ্ছে যে, একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে না পারার মনো:কষ্ট অনেকখানিই লাঘব হয়েছে নতুন এই যুদ্ধে অংশীদার হতে পেরে।

আমার পতাকা যখন আমি বহন করি, তখন স্যালুট জানাই পৃথিবীর তাবৎ দেশের জাতীয় পতাকাকে, আমি যখন জাতীয় সঙ্গীত গাই, তখন আমি সম্মান জানাই অন্য দেশের জাতীয় সঙ্গীতকেও। পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত – দুটোই যেকোনো দেশের জন্য গর্ব এবং অহংকারের।  ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কেন? সম্মান জানাতেই তো! শুরুটা হয়তো হয়েছিল আমার দেশে, আন্দোলন-রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই যে নিজের ভাষার প্রতি সম্মান দিচ্ছে আজ পৃথিবীর সব মানুষ, এই অর্জনে আমাদের কমতি নেই, বরং বেশিই।

এতোসব কথা বলার কারণটা খুবই কষ্টের। দুদিন আগে দু’দুটো রেকর্ড করার খুশিটা কেন জানি আর কেবলই খুশি থাকছে না, একটা বিষন্নতা ছেঁকে ধরছে ক্রমশ:। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর পাকিস্তানে যা শুরু হয়েছে, তা নি:সন্দেহে একজন বাঙালী হিসেবে আমাকে প্রতিবাদী করতেই পারে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে শোক প্রস্তাব আনা, এমপিদের ঢালাও বক্তব্যের জের ধরে আমরা পরিশীলিত প্রতিবাদ জানাই না কেন? সরকার কড়া প্রতিবাদ করেছে পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করে। প্রয়োজনে আরও কঠোর কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। কিছু প্রস্তাব এরই মধ্যে উঠে এসেছে যে, সাময়িকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতার নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, হাইকমিশনারকে ফেরত পাঠানো যেতে পারে…ইত্যাদি ইত্যাদি। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আজ বিকেল ৩টায় পাকিস্তান হাইকমিশন অভিমুখে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে, তাও করা যেতে পারে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, ঘটনা ঘটছে দুটি দেশের মধ্যে, যেখানে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিরাজমান। কাজেই আমাদের অতিআবেগীয় হয়ে এমন কিছু করা যাবে না, যা আমাদের নিজেদেরই ছোট করে দেয় বিশ্বের সামনে।

কাল থেকে দেখছিলাম সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে ঝড় উঠেছে। কী ভাষায় প্রতিবাদ-ক্ষোভ জানানো হচ্ছে, তার উল্লেখ না হয় নাই করলাম। গালিগালাজে পরিপূর্ণ একেকজনের স্ট্যাটাস, মন্তব্য। ভাষার জন্য যে জাতি লড়াই করেছিল একদা, তার ভাষা সুসংযত হওয়া কী বাঞ্ছণীয় নয়?

অতি উৎসাহী কিছু মানুষ পাকিস্তানের পতাকায় প্রস্রাব করছে এমন ছবি পোস্ট করছেন, কেউ কেউ পায়ের তলায় পাকিস্তানের পতাকা একেঁ বাহবা কুড়াতে চাইছেন। বোঝাতে চাইছেন, দেখ, আমি তোমাদের কী ঘৃণা করি। তোমার পতাকাকে কী অসম্মান করি! এসব ছবি দেখে গতকাল থেকেই গায়ে মোচড় দিয়ে উঠছিল। কেন এমন হবে?

কাদের মোল্লাকে ওরা বীর মনে করুক, পারলে ঈশ্বর মনে করুক, তারা যা খুশি তাই করুক, তাদের আমাদের কী? ওরা বলছে মুখে, আমরাও মুখেই কেন এর পাল্টা জবাব দেই না। যদিও ওদের এই বাগাড়ম্বরতায় কালক্ষেপণ করতে আমি মোটেও রাজী নই। দেশ আজ একটা স্মরণকালের সবচেয়ে বড় একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। প্রতিদিন মরছে মানুষ, পুড়ছে মানুষ, দেশের সম্পদ ছারখার হয়ে যাচ্ছে। শপথ নিয়েছি দুদিন আগে দেশটাকে গড়ে তুলবো বলে, আমাদের এখন নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পালা, দেশটাকে সত্যিই সত্যিই রাহুমুক্ত, শত্রুমুক্ত করার পালা। আমরা কেন অন্য দেশের মন্তব্য নিয়ে পড়ে থাকবো?

এভাবে তো পিছিয়েই যাবো কেবল! তাছাড়া ওদেরকে যদি আমরা এতো প্রাধান্যই দেই, তাহলে তো ওরা জিতেই গেল, ওরা তো তাই চাইছে। কেন আমরা তা হতে দেবো? বরং আমরা সবাই মিলে ভাবি, এখন কি করে এই ক্রান্তিকাল থেকে বের হওয়া যায়! কিভাবে রুখে দাঁড়ানো যায় দেশের ভেতরের শত্রুদের বিপক্ষে। বাইরে থেকে কেউ এখন আর এসে সুবিধা করতে পারবে না, এটা তারা যেমন জানে, আমরাও জানি। কিন্তু ভিতরের প্রতিপক্ষকে মোকাবিলাই আমাদের এখন প্রধান কাজ এবং কর্তব্য হওয়া উচিত।

যেটা বলছিলাম, জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত বিশ্বের সবদেশেই সমানভাবে সম্মানিত। অন্যদেশের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করে কিন্তু নিজের সম্মান বাড়ানো যায় না। তাই অনুরোধ করছি, অবিলম্বে অবমাননাকারী পতাকাগুলো সরিয়ে নিন, আসুন পরিশীলিত ভাষায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। একটা জাতীয় পতাকা একজন মায়ের মতোনই সম্মানিত। আসুন, পৃথিবীর সব মাকে সম্মান জানাই, জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

প্রতিটি পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত অর্জনের পিছনের ইতিহাস থাকে রক্তাক্ত। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জন করতে হয় সেই পতাকা। কাজেই পতাকাকে অশ্রদ্ধা বা অসম্মান করে নয়, লড়াই হবে রাজনৈতিকভাবে, প্রয়োজন হলে সামরিক শক্তিতে, কূটনীতিতে। মাকে অপমান করা যাবে না কিছুতেই। অন্যকে অসম্মান করা মানেই পরোক্ষভাবে নিজের অসম্মান ডেকে আনা।

‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’….চলুন, সেই শক্তিটুকু অর্জন করি নিজের ও পরের সম্মান বাঁচিয়েই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.