হেফাজতের ১৩ দফা এবং নারী

burqas-765042রওশন আরা নীপা: একজন আপাদমস্তক বোরখা পরিহিত নারী রেল স্টেশনে তার স্বামীর সাথে এসেছেন, তিনি রেলে করে কোথাও যাবেন, স্টেশনে রেল গাড়ী বেশিক্ষণ থামে না, গাড়িতে ওঠার জন্য প্রচণ্ড ভিড় উপেক্ষা করে যথাসম্ভব পুরুষের স্পর্শ এড়িয়ে নারী গাড়িতে ওঠবার চেষ্টা করেন, একসময় তার শরীর জড়িয়ে থাকা বোরখা রেলের চাকার সাথে বেঁধে যায়, নারী প্রাণপন চেষ্টায় নিজেকে ছাড়াতে থাকে, পারে না, তাঁর পুরুষ সঙ্গী তাকে সাহায্য করে, তাও পারে না, স্টেশনে থাকা অন্য পুরুষরা এসময় সাহায্য করতে এগিয়ে এলে , পুরুষ সঙ্গী বাধা দেয় কারণ তারা পরপুরুষ ! অবশেষে নারী তার পর্দা সহকারে অন্য পুরুষের স্পর্শ এড়িয়ে রেলের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেন! এটি কোন গল্প নয়, বেগম রোকেয়ার জীবনী থেকে নেওয়া একটি সত্য ঘটনা!

২০০ বছরেরও আগে বেগম রোকেয়া ইসলাম ধর্মের তথাকথিত এইসব পর্দা প্রথা থেকে উপমহাদেশের নারীদের শিক্ষার আলো দিতে বাইরে বের হয়েছিলেন।  আজ ২০১৩ সালে এসে হেফাজতে ইসলাম নামধারী ইসলামের তথাকথিত হেফাজতকারীরা আমাদেরকে সেই অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেবার জন্য জেহাদ ঘোষণা করেছেন! গত ৬ মার্চ রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে লক্ষাধিক লোকের এক বিশাল সমাবেশ থেকে সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি পেশ করেছেন, যাঁর ৪ এবং ৫ নং দাবি নিম্ন রূপ-

৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।

অত্যন্ত জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। যাঁর অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। ৯০ এর দশকের পর থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে হাঁটছে। আর এই ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের মধ্যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনুকরণীয় এবং ঈর্ষান্বিত সাফল্য দেখিয়েছে, এর কারণ হিসাবে সারা বিশ্বের গবেষকরা বলেছেন, এটি মিরাকল! কিন্তু আমরা যারা এই দেশে থাকি, এই দেশের মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখি, তারা জানি এটি মিরাকল নয় , এটি সম্ভব হয়েছে কারণ এই দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠি যে নারী সে শুধু চারদেয়ালে বন্দি থেকে ঘর সংসার, আর সন্তান প্রতিপালন করছে না। সে তার স্বামী-সন্তানের হাত ধরে উপার্জন বাড়ানোতে ব্যস্ত! উপার্জনকারী এই নারীদের তালিকায় সবচে উপরে রয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক, তাঁরা যে তাদের দরিদ্র পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনছে তাই নয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও রাখছে বিশাল অবদান। এর বাইরে এনজিও কর্মী, স্কুল শিক্ষিকা, ডাক্তার, নার্সসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবাধ বিচরণ।

হেফাজতে ইসলাম এর ৪ নং ও ৫ নং দাবীর বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখলে খুব ভালোভাবেই বোঝা যায়, ব্যক্তি এবং বাক স্বাধীনতা খর্ব হবার ক্ষেত্রে তাদের মূল টার্গেট নারী। অন্যায়, ব্যাভিচার আর বেহায়াপনা যদিও নারী একা করে না বা করতে পারে না, তারপরও নারীকেই তার মাশুল গুণতে হবে সব দায়ভার মাথায় নিয়ে।

সেদিন ৭১ টেলিভিশনে হেফাজতে ইসলাম এর এক নেতা বললেন, এতো যে ধর্ষণ, এবং নির্যাতন এসিড নিক্ষেপ হচ্ছে তার বড় কারণ নারী। তারা অন্তঃপুর থেকে বাইরে বের হচ্ছে এবং পর্দা করছে না। যদিও আমরা জানি, এইসব ঘটনার শিকার নারী ঘরে এবং বাইরে দু জায়গায়ই হচ্ছে। উনি আরও বললেন, আট বছরের মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে, অথচ আট বছরের মেয়ের শরীর কিভাবে পুরুষকে আকর্ষণ করে তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি।

অর্থাৎ মূল বিষয় হচ্ছে, নারী ঘরে থাকবে, এবং অধ:স্তন থাকবে , সে কখনই স্বনির্ভর বা প্রত্যয়ী হবে না। একারণেই নারী ধর্ষিত হলে ফতোয়ার নামে বেত্রাঘাত, মাটিতে পুঁতে পাথর ছোড়ার মত নিষ্ঠুর শাস্তি শুধুমাত্র নারীকেই পেতে হয়।

হেফাজতে ইসলামের ৫ নং দফায় স্পষ্টভাবেই বর্তমান নারী নীতির বিরোধিতা উপরোক্ত বিষয়গুলিকেই সমর্থন করে। একই সংগে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নারীর যে অভাবনীয় সাফল্য এবং অংশগ্রহণ তা বন্ধ করবার জন্যই এই দাবি। এই দাবিতে সহ-শিক্ষা বন্ধ করার যে অযৗক্তিক দাবি তা মানতে গেলে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই কোন নারী পড়তে পারবে না। শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষা কেন, নারীর জন্য আধুনিক কোন শিক্ষাই সম্ভব না। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ- পাকিস্তানের কিশোরী কন্যা মালালা ইউসুফজাই। ছোট্ট মালালার অপরাধ ছিল স্কুলে যাওয়া এবং মেয়ে ব্ন্ধুদের স্কুলে যেতে উৎসাহ জোগানো।

এ প্রসংগে আমার একটি ব্যক্তিগত ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই , ২০০৫ সালে ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাবার পথে আমার ট্রানজিট ছিল ওমান। প্রায় ২৪ ঘন্টার বিরতি, কিন্তু ওমান এয়ারপোর্টে আমাকে কোনভাবেই লাউঞ্জের বাইরে যাবার অনুমতি দিচ্ছিল না, কারণ আমার পাসপোর্ট বাংলাদেশের এবং আমি নারী হয়ে একা ভ্রমণ করছি। আমি যখন তর্ক করতে শুরু করেছি, তখন ভিসা অফিসার আমাকে ধমকে উঠলেন, এবং বললেন, আমি একজন নারী হয়ে কেন উচ্চ গলায় কথা বলছি! অবস্থা বেগতিক দেখে গালফ্ এয়ার এর এক কর্মী আমাকে উদ্ধার করেন এবং কথা না বলতে অনুরোধ করেন। তার অর্থ হচ্ছে এইসব তথাকথিত ইসলাম নামধারী পুরুষের কাছে নারী কখনই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি, আর পাবেও না।

আজকে নারী যখন এভারেস্ট জয় করছে, মহাশুন্যে যাচ্ছে, জ্ঞান- বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই মধ্যযুগীয় আবদার নিয়ে শুধু নারীকে নয় গোটা সমাজ এবং রাষ্ট্রের সবাইকে ভাবতে হবে এবং শুধু ভাবলেই চলবে না, এখনই প্রতিরোধ করতে হবে, না হলে ২০০ বছর আগে যে সুলতানার স্বপ্ন দেখেছিলেন বেগম রোকেয়া, অবস্থা বেগতিক হলে আজ আবার নতুন করে সেই স্বপ্ন দেখতে বাধ্য হবো আমরা। কিন্তু আমরা তা চাইনা, আমরা চাই এমন এক বাংলাদেশ যেখানে নারী এবং পুরুষ সবার সমান অধিকার। তাই আসুন সবাই মিলেই একে এগিয়ে নিয়ে যাই।

লেখক পরিচিতি: রওশন আরা নীপা

ফিল্ম মেকার ও মিডিয়াকর্মী

ইমেইল: minidi@gmail.com

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.