আমরা যারা একলা থাকি-৬

imp 1উইমেন চ্যাপ্টার: একা থাকা মনে হয় সত্যিই কঠিন, নইলে কিছু মানুষ প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেও নিজের সব মান-সম্মান, ব্যক্তিত্ব জলাঞ্জলি দিয়েও কেন একা থাকার ‘ছোট্ট’ সিদ্ধান্তটা নিতে পারে না? কেন তাকে পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকতে হয়? কিসের জন্য? বা কিসের ভয়ে? সমাজ? লোকচক্ষু?

একা থাকা এক বন্ধু বলছিলেন, ‘সমাজের থোরাই কেয়ার করি। সমাজ কি আমাকে খায় না পরায়, যে তার কথা ভাববো’? তবে সেই বন্ধুটির পরিবার কিন্তু স্বাভাবিকভাবে নেয়নি বিষয়টি। তারা অনেক দূরদর্শী, এমন মেয়ের পরিবারে কেউ ভবিষ্যত প্রজন্মকে বিয়ে করাতে চাইবে না। মেয়েটির যখন সংসার নামক একখানা ‘কমেডি হাউস’ ছিল, তখনও তারা মেনে নেয়নি, এখনও নিচ্ছে না। তাহলে দাঁড়ালোটা কি?

ছাত্রজীবনে আমার আরেক বন্ধু ছিল, একেবারেই একা থাকতে পারতো না। সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি বা প্রেমিকটি হয়তো দু’একদিনের জন্য শহরের বাইরে গেছে, ব্যস, ঝুলে পড়লো আরেকজনের সাথে। কাউকে না কাউকে তার পাশে লাগবেই লাগবে। এমনও হলো যে, বন্ধুটি একসময় অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়ে, সহপাঠীদের মধ্যে ‘হায় হায়’ রব। বাচ্চার বাবা কে? অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জানা গেল বাবার পরিচয়। কিন্তু বিয়ে কবে হবে? বাচ্চার বাবা তখন সাধু-সন্ন্যাসীর ভাব নিয়ে বলে, ‘বিয়ের কি দরকার, মনের মিলই তো সব’। একসময়ে বাচ্চার জন্ম হয়, বাচ্চার সেই বাবা বিদেশ চলে যায়। বন্ধুটি আবার জোড়া বাঁধে, বাচ্চা বড় হয় নতুন কাঁধে চড়ে। ‘বাবা’ ফিরে আসে, ‘কাকা’/’মামা’কেই তখন বাচ্চাটা আপন ভাবে। হায়রে চড়ুইভাতির সংসার। খান খান হয়ে যায় সম্পর্কগুলো। তারপরও জীবন বাঁচে। একসময়ে বন্ধুটি সত্যিই একা হয়, তখন কেউ থাকে না তার পাশে। হয়তো থাকে, কেবল জানা হয় না আমাদের।

এজন্যই বলি, একা থাকা সহজ না, কেউ ইচ্ছে করে ওপথ মাড়ায় না। তবে প্রতিদিন মরার চেয়ে একদিনের একটি সিদ্ধান্ত কিন্তু অনেক জীবনকে বাঁচিয়েও দিতে পারে। এক তরুণী মেয়ের প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, ক্যারিয়ারের জন্য কি সংসার কোনো বাধা? আবার তথাকথিত ‘উপরে’ উঠার জন্য ‘পুরুষ স্পন্সর’ সত্যিই প্রয়োজন? এধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক কেন মেনে নেয় মেয়েগুলো? একটু ভাল থাকার জন্য? নিজের যোগ্যতায় কি উপরে উঠা যায় না? তরুণী মেয়েটা অনেক প্রশ্ন করে।

উত্তর যদিও জানা, তবুও কিছুটা অপ্রতিভ লাগে নিজেকে। নিজের কথা মনে পড়ে যায়। জীবনের বহু পথ হেঁটে এসে আজ কেবলই মনে হয়, না হয়েছে ক্যারিয়ার, না ‘উপরে’ উঠা। সংসার-সন্তান, স্পন্সরহীন জীবনই কি এর জন্য দায়ী?

কিন্তু এই যে একা থাকার আনন্দ, একা সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা, সর্বোপরি যখন খুশি ঘুমিয়ে পড়া, যখন খুশি ঘুম থেকে জেগে উঠার যে স্বাধীনতা, হুটহাট বেরিয়ে পড়া, সেটাই বা কম কীসে! যে মেয়েটি দিনের মেয়াদ শেষ হতে থাকলে ভয়ে কুঁকড়ে যেতো আপন স্বামীর অকথ্য অত্যাচারের কথা ভেবে, প্রতিদিন যাতে নিজ স্বামীর বিকৃত যৌনাচারের শিকার হতে হতো, সেই মেয়েটি যখন একা হয়, তখন তার সর্বোচ্চ শান্তির জায়গা হয় তার বিছানা, আর নিশ্চিন্ত ঘুম। অথচ এই রাতকেই কতোই না ভয় পেতো সে একদিন!

আরেকটি মেয়ের কথা বলি। এটা ঠিক একা থাকার গল্প নয়।

মেয়েটি গ্রাম থেকে এসেছে বেশ কিছুদিন। এসেই কিভাবে যেন নজরে পড়ে গেছে একজন ধনী সুশীলের। সুশীল ভাই তাকে সমাজে উঠানোর সব চেষ্টায় মশগুল। মেয়েটি সবে তারুণ্যে পা দেয়া, সবকিছুই তার চকচকে লাগে, এটা চাই, ওটা চাই। সুশীলের টাকার অভাব নেই, গাড়ি একখান বরাদ্দ, যদি রিকশায় চড়ে পায়ে-গায়ে ব্যথা লাগে! চকমকি সব পোশাক, সাজসজ্জাও লেটেস্ট। বয়সে বাবার চেয়েও বড় একজন মানুষের আনুকূল্য পেয়ে মেয়েটি ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এদিকে মেয়েটির প্রেমে পড়ে এক টগবগে যুবক। প্রেমই যার সম্পদ, সে প্রতিনিয়ত হেরে যেতে থাকে বাহ্যিক সম্পদের ডামাডোলে পড়ে। মেয়েটি জানেও না, জীবনে সে কী হারাতে যাচ্ছে? আর আমরা যারা দর্শক, মেয়েটির প্রতি করুণা ছাড়া আমাদের কিছুই নেই, যে নিজেকে রক্ষা করতে জানে না, তাকে স্বয়ং ঈশ্বরও রক্ষা করতে পারে না।

(চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.