শিক্ষকের আদর্শ

Tania Lopaতানিয়া মোর্শেদ: পড়বার কথা ছিল ইংরেজী সাহিত্যে। তখনকার সময়ে ভর্তি হবার জন্য লিখিত পরীক্ষা দিতে হতো না। মৌখিক পরীক্ষা হতো। অনেক সময় শিক্ষকরাই স্টুডেন্টদের ডেকে নিয়ে পরীক্ষা নিতেন, নিজের বিভাগে ভর্তি করবার পরোক্ষ চেষ্টা হতো। এভাবেই ইংরেজী সাহিত্যে ভর্তি হবার জায়গায় হয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের স্টুডেন্ট।

তখন সব ভাল স্টুডেন্টরা যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল করতেন তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। সারাদিন ক্লাস, বিকালে ছাত্র পড়ানো, সন্ধ্যায় দলের কাজ, রাত দশটা থেকে দু’টো নিজের পড়া! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে এম, এ, পরীক্ষার ফল বেরুবার আগে নাসিরাবাদ কলেজে অল্প কিছুদিন শিক্ষকতা। তারপর আনন্দমোহন কলেজে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪।

কর্ম জীবনের শুরুতেই দলীয় রাজনীতি থেকে সরে যান। পেশাগত কারনে। কারণ শিক্ষকদের দলের কর্মকান্ডে থাকা যায় না, উচিৎ নয়।

কর্ম জীবন শুরু একুশ বৎসর বয়সে। চাকুরীর শুরুতেই পরীক্ষার হলে একদিনে ১০০+ জন নকলকারীকে বহিষ্কার করেছিলেন! তারমধ্যে এন, এস, এফ-এর নামকরা মাস্তানরাও ছিল। পরীক্ষার হলেই দেখে নেবার হুমকি দান! ভোর রাতে সেই আবার বাড়ী পর্যন্ত এসে ক্ষমা চেয়ে গেছে!

১৯৬৪-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান। ২০০২-এ অবসরে যাওয়া। এই দীর্ঘ জীবনে কত যে স্টুডেন্ট! নিজের বিভাগেই নয়, পুরো স্টুডেন্ট সমাজ জানতো, পরীক্ষার হলে তাঁর ডিউটি মানেই খবর আছে। জীবনে কত যে স্টুডেন্টকে পরীক্ষার হল থেকে নকলের জন্য বহিষ্কার করেছেন! তাঁর ক্লাসে স্টুডেন্ট উপচিয়ে পড়ত। আমার এক সহপাঠি যখন জেনেছিল তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক, বলেছিল যে তার বোন (তাঁর সরাসরি ছাত্রী) বলেছে যে তারা এই শিক্ষককে “প্রিন্স স্যার” নামে বলে থাকে নিজেদের মধ্যে! আমি জানতে চাইনি কেন। তবে এটুকু জেনেছিলাম যে তাঁর ক্লাস স্টুডেন্টদের খুব প্রিয়। কখনো ক্লাস বাদ দিতেন না। এইজন্য বলছি যে, অনেক শিক্ষকই এটা করতেন না।

পুরো বিভাগের স্টুডেন্টদের জানা ছিল, পড়ার বিষয়ে যা কিছু আলোচনা তা বিভাগেই করতে হবে। বাড়ীতে কোনো স্টুডেন্টের প্রবেশাধিকার নেই! কেউ যদি বাড়ীতে এসেই পরতো, দরজা থেকেই বিদায়! বিভাগে দেখা করো। কঠিন নিয়ম ছিল! কেবলমাত্র নিয়ম ভেঙ্গেছিলেন তাঁর আন্ডারে এম, ফিল আর পি, এইচ, ডি স্টুডেন্টদের জন্য। খুব প্রয়োজনে কখনো কখনো। অনেকেই তারা চাকুরীরত অবস্থায় পড়তেন। দিনে চাকুরী থাকত।

আমার মা’কে যখন বিয়ে করলেন, আমার মা তখন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী ছিলেন। পড়া বন্ধ হয়ে গেল! কারন এক বিভাগে পড়া যাবে না। যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করছিলেন আমার মা। পরবর্তীতে বি,এ পাস করে অন্য বিভাগ থেকে মাস্টার্স করতে হয়েছিল! একই সময়ে, পরবর্তীতেও অনেক অনেক শিক্ষকের (বিভিন্ন বিভাগের) স্পাউসরা একই বিভাগ থেকে পড়েছেন, কেউ কেউ খুব ভালো রেজাল্ট করে বিভাগেই যোগ দিয়েছেন। বাবার আদর্শের কারণে মাকে মূল্য দিতে হয়েছে! পরবর্তীতে দু’জন আত্মীয় তাঁর বিভাগে পড়েছেন। তাদের পড়বার সময় তিনি সেই ব্যাচগুলোর সব ধরণের বিষয় থেকে দূরে থেকেছেন। নিজের দু’জন অতি নিকট আত্মীয় একাধিকবার (অন্য বিভাগে) সাবসিডিয়ারি পরীক্ষায় পাশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, শেষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যেতে হয়েছে সেখানকার ডিগ্রি বাদে। একদিনও ভাবেননি যে “কিছু” বলে দেখা যায় কিনা তাদের জন্য। পরবর্তীতে তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম, এস, সি করেছেন। তাদের সাথে তাঁর সম্পর্ক বললে এ’যুগে কেউ বিশ্বাস করবে না। সে সময়ও কারো বিশ্বাস করবার কথা ছিল না!

চূড়ান্ত স্পষ্টবাদীতার জন্য মানুষের পছন্দ ও অপছন্দের মানুষ ছিলেন। দ্বিতীয়টাই হয়ত বেশী। সত্যবাদী হবার কথা বই-এ সবাই পড়ে, হতে বলে থাকে কিন্তু সত্যবাদীকে সবাই সব সময় পছন্দ করে না। তখনই পছন্দ করে যখন তা কারো অনুকূলে যায়। যখনই তা প্রতিকূলে যায়, তখন সত্যবাদীকে অপছন্দ করা শুরু। তাঁর সত্যবাদীতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখরতাকে কেউ কেউ নিজের, নিজেদের স্বার্থে কখনো কখনো কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর বুঝতে হয়ত কিছু সময় লেগেছে। মানুষ আসলে নিজের প্রতিচ্ছায়া খোঁজে অন্যের মাঝে। সব মানুষ যে সব সময় সত্য বলে না তা বুঝতে, মানতে আমারও সময় লেগেছে! শিক্ষাটা, বোধটা যে তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া! তাঁর মানতে যেমন কষ্ট হয়েছে, আমারও হয় তেমনই।

কোন একটিও বই লেখেননি। আমার মায়ের দুঃখ। বাবা বলতেন, “আমি নোট বই লিখিনা।” জানতে ইচ্ছে করে কেন তা বলতেন। যদিও কিছুটা ধারণা আছে! আরো জানতে ইচ্ছে করে তাঁর শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে। তাঁর সাথে মতের মিল ও অমিলের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবার ইচ্ছেটা হয়েছে আহমদ ছফার “যদ্যপি আমার গুরু” বইটি পড়বার পর। বাবার নিজের বিষয়ের সব বই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের লাইব্রেরীতে দেওয়া হয়েছে। তাঁর লেখাগুলো, বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে বের হওয়া, এক জায়গায় করে ছোট্ট একটি বই বের করা হয়েছে (খুবই অল্প কপি), সবই মায়ের কাজ, আমার অনুরোধে। ভাবছি তাঁর থিসিসটি যদি ছাপানো যেতো!

নারীর অধিকারে কতটা বিশ্বাসী ছিলেন তা বোঝা যায় আমার মায়ের কর্ম জীবন সম্পর্কে ভাবলেই। মা পড়া বাদ দেবার পর, আমার জন্মের পর কর্ম জীবন শুরু করেন। মায়ের কাজ ছিল বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। ভীষণ ব্যস্ত জীবন। দশটা পাঁচটা অফিস নয়। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো। ট্যুর হচ্ছে কাজের অংশ। সেই ১৯৬৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত (মাঝে ১৯৭৩ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত বাবার পড়বার জন্য বাইরে আসা, মা’র মাস্টার্স করার কারনে বন্ধ ছিল), প্রতিটা মুহূর্তে বাবা ছিলেন মায়ের কাজের সাপোর্টার।

আমি বেশ কিছু বৎসর ধরেই মাকে বলেছি ছেড়ে দিতে, অনেক তো হলো, আর কত ইত্যাদি। বাবা একদিনও বলেননি। মুখে, কথায় অনেক প্রগতিশীল মানুষ দেখেছি, দেখছি। তাঁদের অনেককেই সমাজে দেবতূল্য ভাবা হয়, মেধার কারনেই হয়ত। কিন্তু আমি জানি, বুঝি তাঁদের অনেকেই নারীর সম মর্যাদা, সম অধিকারে কতটা আসলেই বিশ্বাসী! যুগের প্রয়োজনে হয়ত এখন নিজের কন্যা, পুত্রবধূর কর্ম জীবন নিয়ে কিছু বলেন না। কিন্তু তাঁদের স্ত্রীদের জীবনের দিকে তাকালেই, ভাবলেই অনেক না বলা কথা অনুভব করা যায়। তাঁদের স্ত্রীরাও হয়ত তাঁদের এই বিষয়ের ঘাটতি নিয়ে কখনো ভাবেননি। অনেক মানুষই ভাবে না নিজের অধিকার নিয়ে, বিশেষত নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। আর বিখ্যাত, পূজণীয় ব্যক্তির স্ত্রীদের অনেকেই একটা মোহের মধ্যে বাস করেন, করতেন! আমার বাবার সত্যবাদীতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নারীর সমানিধাকারের বিশ্বাস এই গুণগুলোর জন্য শ্রদ্ধা করি। জানি এই গুণগুলো অনেক নামী-দামী মানুষের মধ্যে নেই।

বোরখা পড়া (শুধু চোখ দেখা যায়) এমন পরিক্ষার্থীর ভাইভা নেবার সময় বলতেন মুখ দেখাতে হবে! কারন অন্য কোনো স্টুডেন্ট তার জায়গায় পরীক্ষা দিচ্ছে কি না তা নিশ্চিত হতে হবে! ছাত্রদের এমন আবাসিক হলের প্রভোস্ট হলেন যার প্রভোস্টের আলাদা বাড়ী নেই। হল থেকে নিজের বাড়ী দূরে, সেই যে স্টুডেন্টদের বাড়ীতে প্রবেশাধিকার নেই একই চিন্তা! সেই হলের খুব দূর্নাম ছিল। দলীয় রাজনীতির আখড়া ছিল। আগের প্রভোস্টকে ঘরে তালা দিয়ে রাখবার ঘটনা ছিল। পুরো সময় নিজের ব্যক্তিত্ত্ব দিয়ে কাজ করেছেন। দলের পান্ডাদের রুম দখলের ব্যবসা বন্ধ করেছেন। ছাত্র নেতা শাহজাহান সিরাজ নিহত হবার সময় সেই হলে একজন হকারেরও মৃত্যু হয় গুলিতে। প্রচন্ড গণ্ডগোলের মধ্যে তিনি ছিলেন সেই জায়গায়। ছাত্রদের দেখা, ঘটনা শামাল দেবার চেষ্টা করে গেছেন। একই সময়ে আমাদের বাসা থেকে তাঁরই কোন কোন সহকর্মীরা ফোনে জানতে চাইছেন কি হচ্ছে? আমার মা তাঁদের অনুরোধ করেছেন সেখানে যেতে। তাঁরা যাননি। পরে শাহজাহান সিরাজের মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতায় প্রতক্ষ্যদর্শীর ভাষণ দিয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ!

স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক আগেই পাকিস্তানপন্থী শিক্ষকদের কুনজরে পড়েছেন। ফলাফল, একাধিকবার উচ্চ শিক্ষার স্কলারশিপ হারানো। তাঁর হওয়া স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে পাকিস্থানপন্থী শিক্ষককে। অনেক পরে ১৯৭৩-এ কানাডার কুইন্সে যান মাস্টার্স করতে। উর্দূভাষী শিক্ষকের আন্ডারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিষয়ে থিসিস! শিক্ষক অবশ্যই তা পছন্দ করেনি। ডিগ্রী শেষে যখন ফিরে আসছেন (১৯৭৫-এ) একাধিক মানুষ বলেছে, কি করছেন? দেশে তো দূর্ভিক্ষ চলছে। থেকে যান।

তাঁকে টেনেছেন জন্মদাত্রী মা আর দেশমাতা। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার আদর্শ পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। তাঁর বাবা বৃটিশ শাসকের চাকুরী করে সাদা বৃটিশ ব্যক্তিকে আফিমসহ হাতকড়া পরিয়ে ধরেছিলেন অ্যান্টাইকরাপশন ইন্সপেক্টর হিসাবে কর্মরত অবস্থায়! পুরষ্কার হিসাবে পেয়েছিলেন দূর পাহাড়ী বনাচঞ্চলে বদলি! জীবনের নির্মম সত্য অনেক বৎসর পর, বাবার নিজের সন্তানকে বলা, “আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না।” তিনি ততদিনে বুঝে গেছেন যে তাঁর আদর্শগুলো ধারণ করা মেয়েটি এই জন্মভূমিতেই বড়ই বেমানান তখন! তিনি যুগের, সমাজের উপযোগী করে সন্তানদের বড় করেননি!

শেয়ার করুন: