আমরা যারা একলা থাকি-৫

উইমেন চ্যাপ্টার: রিনা বলছিল, ওর পেটে যখন দ্বিতীয় বাচ্চাটি আসে, স্বামী মৃণাল কিছুতেই মেনে নিচ্ছিল না। কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। মৃণালের এমন একটা নির্লিপ্ত ভাব ছিল যে, কিছুতেই কিছু যায় আসে না। সংসারে বাজার করা থেকে শুরু করে সব কাজ একাই সামলাতে হতো রিনাকে। অন্যদিকে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বাসায় আড্ডার আখড়া বসিয়েছিল বাড়তি যন্ত্রণা দিতে।

woman-with-childরিনার মনে জেদ চেপে যায়, যেভাবেই হোক, একটি সুস্থ শিশুর জন্ম সে দেবেই। প্রচুর অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন তার সইতে হয়েছে গর্ভাবস্থার পুরো সময়টা জুড়েই। যেদিন মেয়েটির জন্ম হয়, সেদিন সকালেও পেটে লাথি মেরেছিল সেই পুরুষটা, যে কিনা এই সন্তানের আইনত পিতা।

কিন্তু রিনা দমে যায়নি। তার মনের জোর ছিল প্রচণ্ড। সেই জোরেই সে মা হয় দ্বিতীয়বারের মতোন, সুন্দর একটি মেয়ে জন্ম নেয়। সেই মেয়ে আজ ১০ বছরের। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এবার রিনা একাই সামলাচ্ছে দুই শিশু-সংসার সব। এখন সে বলতে পারে, ‘বড় নিশ্চিন্তে আছি গো দিদি, বড় শান্তিতে আছি’। দুই সন্তানের সাথে প্রতিদিনের দু:খ-আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। ছেলেমেয়ে দুটোই হয়েছে লক্ষ্মী।

রেহানা আক্তারের জীবনটা বেশ অন্যরকম। দু-সন্তান নিয়ে একা হয়ে গিয়েছিলেন সেই অনেক আগে। সেইসময়ের কথা খুব একটা জানা যায় না, বলতে চান না তিনি। তারপর একজনের পদার্পণ ঘটে তার জীবনে। বাচ্চাদের দায়িত্ব নেয়, কিন্তু সংসার চালান রেহানা একাই। বাচ্চারা হয়তো ‘একজন বাবা’ পায়, কিন্তু রেহানা ঠিক ‘সুখ-দু:খের বন্ধুটিকে’ পান না। এভাবেই চলে যায় জীবন সংসারের সিংহভাগ সময়। টেনে নিতে নিতে মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে উঠেন তিনি। তিনভাগ সময় কেটে গেছে এরই মাঝে, এখন প্রায়ই তিনি ‘একা’ হওয়া জীবনের সুখ নিতে চান। মানুষের মাঝে মানুষ তেমন না পেয়ে একাই কাটিয়ে দেওয়া এই জীবন আর ভারী ঠেকে না। পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াতে চায় তাঁর মন, বেরিয়ে পড়তে চায় অজানা সুন্দরের আশায়। সঙ্গীরা তাঁকে আশ্বাস দেন, হবে হবে। রেহানাও ভাবতে চান, হবেই হবে। জীবন একটাই। একে এভাবে শেষ হতে দেওয়া যায় না।

রিনা, রেহানা, মনিকা সবাই শেয়ার করে নিজেদের কথা।

মনিকার সেই ২২ বছর থেকেই প্রকৃতপক্ষে একা। বিয়ে করেছে, সন্তানের মা হয়েছে, কিন্তু পূর্ণ সংসার বলতে যা বোঝায় তা তার কখনই হয়নি, সন্তানদের বাবাকে সে পায়নি। মনিকার ভাষায়, জন্ম দিলেই কেউ বাবা হতে পারে না, তাকে বাবা হতে হয় বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে। দায়িত্ব নিতে হয়, তার স্বামী সেটা নেয়নি। বরং পালিয়ে গেছে সংসার থেকে।

সেই ২২ বছর বয়স থেকে একাই সব সামলাচ্ছে মনিকা। সন্তানকে পৃথিবীতে আনা থেকে শুরু করে তাদের প্রতিপালন করা, লেখাপড়া শেখানো, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, সব কাজ। মা আর গৃহকর্মী ছাড়া আর কেউ ছিল না তার এই লড়াইমুখর জীবনে।

একবুক নি:শ্বাস নিয়ে মনিকা জানায়, সকাল সাড়ে ৬টা থেকে দিন শুরু হয়ে শেষ হতো রাত ১২টায়। শুধুমাত্র সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে তাকে একটা নয়, চাকরির পাশাপাশি দুইটা-তিনটা কাজ করতে হতো। সকালে বাচ্চাদের সে ঘুমে দেখে যেত, রাতে এসেও সে পেত ওই বিছানাতেই। সাপ্তাহিক ছুটিটাও মিলতো না। ছুটির আগের দিন রাতে বাসে করে চলে যেতো ‘বাড়তি’ কাজে, সারাদিন কাজ করে রাতে আবার বাস ধরে ঢাকায় ফিরে সকালে অফিসে ছুটতো।

শুরুর দিকের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে মনিকা।

মেয়েটির জন্মদিন ছিল সেদিন। অথচ হাতে একটা টাকাও নেই। চাকরি আজ হবে, কাল হবে বলে কেবল তারিখ পেছাচ্ছে। যেখানে চাকরি হওয়ার কথা চলছে, সেখানে বেশ কয়েকজনের সাথে এরই মধ্যে তার পরিচয় হয়েছে। মাঝে মাঝেই যায় সেখানে, প্রয়োজনীয় কিছু ফোন সারে। আজও গেল। মামাতো বোনকে ফোন করে জানালো, আজ আসার দরকার নেই, মেয়ের জন্মদিনটা করছে না। কিন্তু কেন করছে না, তা আর বলে না। ফোন রেখে, টলোমলো দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত পায়ে বাসার দিকে পা বাড়ায়। চাকরির আজও কোন খবর নেই। এমন সময় পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডাকে। একজন বড় আপা। পিছন ফিরতেই উনি বলে উঠেন, ‘যদি কিছু মনে না করো, আমি তোমাকে কয়েকটা টাকা দেই, তুমি মেয়ের জন্মদিনটা করো’। মনিকার চোখ ছলছল করে উঠে। বুক ফেটে কান্না আসে। কিন্তু বের হতে দেয় না, জোর করে চেপে রাখে। মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। এছাড়া যে তার কোন উপায়ও নেই। এভাবে হাত পেতে টাকা নিতে অভ্যস্ত নয় সে, কিন্তু সেই থেকেই শুরু হয়। বড় আপা পাঁচ হাজার টাকা দেন। মনিকা সেই টাকা নিয়ে হাওয়ার বেগে বেরিয়ে আসে অফিস থেকে। পথে দোকান থেকে তেল,চাল,ডাল, মাংস কিনে বাসায় ফেরে। কাজের মেয়েটি তার আট মাস বয়সী ছেলেটাকে কিছুই না পেয়ে চালের গুড়া পানিতে সেদ্ধ করে খাইয়ে দিচ্ছে। মনিকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ডিম সেদ্ধ করে ছেলেকে খাওয়ায়, কাজের মেয়েটিকে রান্না বসাতে বলে সে বাইরে যায় আবার। ছয় পিস পেস্ট্রি কেক নিয়ে বাসায় ফেরে। আজ এ দিয়েই হবে জন্মদিন। তবুও তো কেক, ছয় বছরের মেয়েটি তাতেই খুশি হয়।

আজ হয়তো সেদিনের সেই অর্থকষ্ট নেই, কিন্তু একেবারেই যে নেই, তাইবা কি করে বলা চলে! বাচ্চারা বড় হয়েছে, তাদের খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খায় মনিকা। নিজের বলে কিছু থাকে না। এভাবে চলতে চলতে মনিকা রোবট হয়ে যায়, সেখানে না থাকে প্রেম, না থাকে মানবিকতা। কঠোর জীবনে পথ চলতে গিয়ে প্রায়ই হোঁচট খায় সে, তারপরও উঠে দাঁড়ায়, চলে, হাসে, কাঁদে।

রিনা, রেহানা বা মনিকা কাউকে জীবন করেনি ক্ষমা- এটা ভেবে মনে মনে তারা শান্তি পায়। কিন্তু অন্যায়টা যে কোথায় ছিল, সেটাও মনে করতে পারে না কেউ।

(চলবে)

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.