উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক: বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, এখনো বিশ্বের সাতটি দেশে ‘ডাইনি’ কিংবা ‘কালো জাদুকর’ সন্দেহে নারীদের হত্যা করা হয়।
সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মধ্যযুগের শুরুতে এক ইউরোপেই ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে কয়েক লাখ। যুগের পরিবর্তন হলেও এই অনুশীলন এখনও অনেক দেশেই বিদ্যমান।
২০০৯ সালে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘কালো জাদুকর’ সন্দেহে নারী ও শিশুদের হত্যা করার প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবাধিকার গ্রুপ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নারীদের এ ধরনের অমানবিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
নিচে কয়েকটি দেশের উদাহরণ দেওয়া হলো।
সৌদি আরব
সৌদি আরবের ধর্মীয় পুলিশ বিভাগে ‘ডাইনি দমন’ নামে একটি ইউনিট আছে। কালো জাদু করে এমন লোকদের ধরপাকড় এবং তাদের উচ্ছেদ করার জন্য এ ইউনিটকে পাঠানো হয়। শরিয়া আইনে পরিচালিত সৌদি আরবে জাদুটোনা কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ২০০৭ সালে সৌদি পুলিশ একজন অভিযুক্ত জাদুকরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। একই অভিযোগে কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন নারীর মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে আমিনা বিনতে আবদেল হালিম নাসের নামে একজন নারীকে জাদুকর সন্দেহে হত্যা করায় সারাবিশ্বে তোলপাড় উঠে। প্রাচীনকালের নিউ ইংল্যান্ডের মতো সৌদি আরবের এসব জাদুকর তাদের শত্রুদের বশ করতে জাদুকে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। সৌদি পরিবারে গৃহস্থালী কাজে জড়িত বিদেশি নারীদের জাদুকর হিসাবে অভিযুক্ত করা হয়।
তাঞ্জানিয়া
মাত্র দু’বছর আগে উত্তর আফ্রিকার এ দেশে কালো জাদুবিদ্যা চর্চা করার অভিযোগে আনুমানিক ৬০০ বৃদ্ধ নারীকে হত্যা করা হয়। ধর্মীয় ও গণজীবন সংক্রান্ত পিউ ফোরাম তাঞ্জানীয়দের মধ্যে জাদুর ব্যাপক প্রভাব দেখতে পেয়েছে। কখনো কখনো জাদুকরদের হত্যা করার পরিবর্তে তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। যে দেশে মাথাপিছু আয় দৈনিক ২ ডলারের নিচে, সেই দেশে একজন নারী জাদুকর রোগ বালাইয়ের চিকিৎসা এবং ভূত পেতনির আছর দূর করার জন্য ২০ থেকে ১২০ ডলার পর্যন্ত পারিশ্রমিক দাবি করে।
গাম্বিয়া
গাম্বিয়ার একনায়ক ইয়াহিয়া জামেহ জাদুকর নির্মূলের নামে নিজ দেশের নাগরিকদের ধরপাকড়, নির্যাতন ও হত্যা করছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক হিসাবে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জামেহর গুপ্ত পুলিশ অজ্ঞাত বস্তুর একটি মিশ্রণ পানে বাধ্য করায় কমপক্ষে ছয়জনের মৃত্যু হয়। আরো কয়েক ডজন স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় আক্রান্ত হয়।
নেপাল
গত বছর একজন গণক একটি ছেলেকে হত্যা করার জন্য একজন নারী জাদুটোনাকারী অভিযুক্ত করলে জনতা তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে। নেপালিরা বিশ্বাস করে যে, মঙ্গলের জন্য জাদুবিদ্যাকে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু অনিষ্টকর জাদুবিদ্যা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। নেপালের পরশ জেলায় প্রতিবেশির মেয়ে প্রতিভাকে জাদুটোনা করার অভিযোগে এ বছর জনতা ৪৫ বছরের পার্বতী দেবী চৌধুরীকে পিটিয়ে হত্যা করে। নেপাল সরকার জাদুটোনাকারী হত্যা করার পক্ষে নয়। এ হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের অভিযোগে নেপালি পুলিশ তিনজন নারীকে গ্রেফতার করেছে। অতীতে জাদুটোনার অভিযোগে আরেকজন নারীকে হত্যা করায় কয়েকজন পুরুষকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ভারত
গত জুনে জাদুটোনা করে কয়েকটি শিশুকে হত্যা করার সন্দেহে একদল নারী অপর দু‘জন নারীকে হত্যা করে। পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেফতার করেছে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে জাদুবিদ্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে আইন প্রণয়ন করেছে।
পাপুয়া নিউগিনি
একদল জনতা জাদুটোনা করে একটি ছেলেকে হত্যার অভিযোগে একজন তরুণী মাকে নির্যাতন করে হত্যা করে। বিপুল সংখ্যক লোকের সামনে এ নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। তাদের কেউ কেউ পুলিশকে তাড়া করে। পাপুয়া নিউগিনির প্রধানমন্ত্রী দুঃখ করে বলেছেন, সন্দেহভাজন নারী তান্ত্রিকদের হত্যা করা নিষিদ্ধ হলেও তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা মানুষের সাধারণ ধারণা হচ্ছে যে, জাদুটোনা করে অন্যকে হত্যা করা যায়।
উগান্ডা
উগান্ডায় ডাইনি বা জাদুটোনাকারী সন্দেহে মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। গ্রামবাসীরা প্রথমে জাদুকর সন্দেহে একজন লোকের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। নির্মমতার এখানেই শেষ নয়। পরে স্থানীয় লোকেরা লোকটিকে বেঁধে শিরশ্ছেদ করে। এক্ষেত্রে পুরুষ-নারীতে ভেদাভেদ নেই।
উল্লেখিত দেশগুলোতে গ্রামের একদল মানুষ জাদুটোনায় বিশ্বাস করে। আবার আরেকদল এ বিদ্যা চর্চা করার অভিযোগে তাদের হত্যা করে। সৌদি আরব ও গাম্বিয়ার মতো কয়েকটি দেশের সরকার এ বিশ্বাসকে আঁকড়ে রেখেছে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তা ব্যবহার করছে। তবে অন্য দেশগুলো মধ্যযুগীয় এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।