উইমেন চ্যাপ্টার: আজকের প্রসঙ্গ ফোন। ফোন, বিশেষ করে মোবাইল ফোন এখন আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ। কাজের হোক, বা অকাজেরই হোক, ফোন গুরুত্বপূর্ণ। সেই ফোনই আবার সব বিড়ম্বনার আধার।
কিশোরী বয়সে বাসায় টেলিফোন থাকাটা ছিল ভয়াবহ যন্ত্রণার। ক্রস কানেকশান ছাড়াও নানা ঘটনা তখন ঘটতো। ফোনে তখন অভিভাবকরা তালা মারতেন। কিন্তু রিসিভ তো বন্ধ হতো না। দুপুরের পর সবাই যখন গা এলাতেন, তখনই বেজে উঠতো সেই ফোন। কিশোরী চপলা মনও কিছুটা যে অপেক্ষা করতো না ফোনের, তা আর অস্বীকার করি কি করে! এমন ঘটনাও আছে, ফোনের অচেনা-অদেখা মানুষটিও কখনও কখনও দরজায় কড়া নাড়তো, বাসার ভিতরে তখন ১৮০ মাইল বেগে ঝড়ো হাওয়া, মনের ঘরেও ঝড়। বড়দের চোখ রাঙানী। এই ঘটনার পর ফোনও বন্ধ, দেখা তো হলোই না। আবার অন্য কিছু নিয়ে মেতে উঠতো তখনকার সেই মন।
ভাগ্যিস আমাদের তারুণ্যে মোবাইল ফোন ছিল না। থাকলে হয়তো ভাললাগা বা প্রেমের প্রকৃত রসটুকুই নেওয়া হতো না। আজকাল যেমন হয় না। কোথাকার প্রেম কোথায় গড়াতো, কে জানে!
কিন্তু এখন এই পড়ন্ত বেলায় কাঁহাতক জ্বালা সহ্য হয়! গতকালই এক ছোট ভাই (একসময়ের সহকর্মী), এর সাথে দেখা ধানমন্ডিতে। তাড়াহুড়োর মধ্যেই ফোন নম্বর নিল। ভাবখানা এমন ছিল যেন, সে পারলে তখনই রিকশায় উঠে পড়ে আমার। কোনরকমে পাশ কাটিয়ে বাড়ি ফিরি। রাত সাড়ে ১২টায় তার ফোন। বেশ অবাকই হলাম। এতো রাতে কেন? ধরিনি। আজ রাতেও একই সময়ে একই ফোন। বেশ বিরক্তই হলাম ওর এই আচরণে। খুব ভাল করেই ছেলেটি জানে আমার একা থাকার বিষয়টি। তাই সবদিক দিয়েই ছোট হওয়া সত্ত্বেও এতোটুকু বাধলো না কল দিতে?
ও না হয় মফস্বলের ছেলে, কিন্তু বিদেশে থাকেন, নামকরা একজন, প্রায়ই ফোন করে ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের কথা বলে যান। তার কথায় ‘আমি আমি’ ভাবটা প্রবল। শুনে যাই শুধুমাত্র উনি মানী-গুরুজন বলেই। একদিন ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যখনই জানলেন, একা থাকি, কলটা কেটে গেল। কিন্তু সেদিন থেকে শুরু হলো নতুন যন্ত্রণা। মধ্যরাতে বা শেষরাতে কল। দেশের বাইরে থেকে আসা কল চিনতে অসুবিধা হয় না। একবার না, দুবার না, এক রাত না, দু রাত না। এ ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটতেই থাকে। মাঝে মাঝে কল রিসিভ করি, কিন্তু ওপ্রান্তে তখন সীমাহীন নিস্তব্ধতা। ধরেই নেই, কণ্ঠ শুনেই শান্তি পাচ্ছে অপর প্রান্তের মানুষটি (যদি তিনি এলিয়েন না হয়ে মানুষ হন)। মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বেশ সজাগ, তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না, ফোনটা কোথা থেকে আসে। অদ্ভুত লাগে সব।
একবার একটা টিভি চ্যানেলে কাজের অফার এলো। ভাল কথা। কিন্তু শুরু হলো নিয়োগদাতার ফোনের ওপর ফোন। বিশেষ করে রাত চারটায় যখন ফোন আসতো, তখন কিছুটা অসহায়ই লাগতো নিজেকে। কেন এই ফোন? ধরতাম, বুঝতে চেষ্টা করতাম। উনি তখন বলতেন, ২৪ ঘন্টার চ্যানেলে কাজ করার যোগ্যতা আছে কিনা, তাই পরীক্ষা করে দেখছেন। শুনে হাসতাম। উনি আমার ঘুম ভাঙিয়ে আরও অনেক গল্প করতেন, তার জীবনের মেয়েদের কথা। কে, কীভাবে তাকে পেতে চেয়েছে বা পায়, এসব কাহিনী। আশ্চর্য যে, সেই মেয়েগুলোকে আমি চিনি এবং ভাল করেই জানি। এসব গল্পের মাজেজা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ভাগ্য ভাল যে, অল্প সময়েই সেই কলদাতা বুঝে যান, ‘আমি সেই টাইপের না’। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
আবার আরেকজন ডাকসাইটে নিয়োগদাতা রাত ১২টার পর ফোন দিয়ে জিজ্ঞ্যেস করতেন, ঘুমোইনি কেন? ক্লান্ত লাগছে কিনা! বলতেন, ‘আমি যেন একটা শাওয়ার নিয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়ি’। তার এই অযাচিত পরামর্শে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও ‘খেলো’ মনে হতো। এসব পাশ কাটিয়েই আমাদের অনেকের এগিয়ে চলা।
অনেকদিন পর ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া ছাত্রজীবনের এক বন্ধুকে। ঠিক চিনতে পারছিলাম না। প্রায়ই কথা হতো। এক কথা-দু কথার পর নিজের জীবনের কথা এসেই যায়। জানা হয়ে যায়, আমার একা থাকার কথা। বন্ধুটি বদলে যেতে থাকে। বলে, তোমার মন খারাপ হলে আমাকে কল দিও, কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবো। প্রায়ই কল আসে তার নম্বর থেকে। এপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করেও কোন সাড়া পাই না। নিজেই ফোন করি, বলে যে, স্যরি, চাপ পড়ে কল চলে গেছে। এভাবে চলে দিনের পর দিন। ফলে মন খারাপ হলেও বন্ধুকে আর জানানো হয় না, সম্পর্কটায় ভাটা পড়ে যায় কিছু ফোন কলের কারণে।
তারুণ্যে বা যৌবনে এসব উটকো কলে শরীর জ্বালাপোড়া করতো, এখন করে না। করুণা বোধ হয়। কেউ যদি ভেবে থাকে, একা নারী মানেই এজমালি সম্পত্তি, তাহলে তাদের একটা কথাই বলবো, একা থাকার সম্পূর্ণ মানসিক ও সামাজিক শক্তি, সেইসাথে অর্থনৈতিক শক্তি পুরোপুরি আছে বলেই একা থাকার সিদ্ধান্ত। নইলে তো সারাজীবন অন্যদের মতোন মাথানত করেই সব মেনে নিতাম। কিন্তু তাই বলে একা নারীরা ‘বারোয়ারি’ নয়। ইচ্ছা করলেই তাদের সাথে ‘অন্যরকম’ ব্যবহার করা যায় না। প্রচণ্ড স্বাতন্ত্র্যবাদী, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলেই তাদের থাকা হয়নি যৌথ সংসারে। কিন্তু তাই বলে সংসার থেকে তো ছুটি মেলেনি তাদের। ছেলেমেয়ে মানুষ করছে, চাকরি করছে, দৌড়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।
রীতিমতো দশভুজা হয়ে তারা চারদিক সামলে যাচ্ছেন। স্যালুট যদি কারও পাওয়ার থাকে, তবে তাদেরই প্রাপ্য। ঘরে-বাইরে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সাফল্যের দিকে। হার না মানা এসব চরিত্রকে কলুষিত করে কার সাধ্য!