উইমেন চ্যাপ্টার: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা লীলা নাগের জন্মদিন ছিল ২১ অক্টোবর। ১৯০০ সালের এই দিনে আসামের গোয়ালপাড়ায় জন্ম নেন এই বিপ্লবী নারী। মারা যান ১৯৭০ সালের ১১ জুন।
উপমহাদেশে নারীজাগরণ আন্দোলনেরও কিংবদন্তীতুল্য তাঁর নাম। তিনি নারী জাগরণকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সমাজের অবহেলিত নারীদের মূলধারায় এনে আলোকিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ছিলেন অখণ্ড ভারতবর্ষের একজন কট্টরবাদী বামপন্থী নেত্রী ও সমাজ সংস্কারক। সবচেয়ে বড় পরিচয় তাঁর, তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একজন।
তাঁর জীবনে লক্ষ্যই ছিল দুটি। এক, ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করা; দুই, নারী জাগরণের পাশাপাশি আর্ত-মানবতার সেবার ব্রত গ্রহণ করা।
লীলা নাগের বাবা গিরীশচন্দ্র নাগ ছিলেন অবসর প্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট। মায়ের নাম ছিল কৃষ্ণলতা নাগ। তার বাবার পরিবার তৎকালীন সিলেটের অন্যতম সংস্কৃতমনা ও শিক্ষিত একটি পরিবার হিসেবে বেশ নাম-ডাক ছিল। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে লীলা নাগ বিয়ে করেন বিপ্লবী অনিল রায়কে। বিয়ের পর তার নাম হয় লীলা রায়।
তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় বিহারের দেওঘরের একটি স্কুলে। তারপর ১৯১১ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পযৃন্ত তিনি পড়াশোনা করেন ঢাকা ইডেন হাইস্কুলে। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ‘পদ্মাবতী’ স্বর্ণ পদক লাভ করেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল়য়ে ইংরেজি বিষয়ে এমএ ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রীধারী। তখনকার পরিবেশে সহশিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বলে লীলা রায়ের মেধা ও আকাঙ্খা বিচার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চান্সেলর ডঃ হার্টস তাকে পড়ার বিশেষ অনুমতি দিয়েছিলেন। তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। বলা যায়, তাঁর অনমনীয়তা ও দৃঢ়তার কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার পথ খুলে গিয়েছিল।
১৯২১ সালে ছাত্রী থাকা অবস্থাতেই তিনি নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার কমিটির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯২৫ সালে শ্রীসংঘ নামের বিপ্লবী দলে যোগদান করেন এবং ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাঙালি নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ঢাকার আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় (তৎকালীন নারীশিক্ষা মন্দির) প্রতিষ্ঠা করেন। ভারত বিভাগের পর লীলা নাগ কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১৯২৬ সালে পরীক্ষা পাশের পর তিনি নারীশিক্ষার লক্ষ্যে ১২ জন সাথী নিয়ে গড়ে তোলেন ‘দীপালি সংঘ’। এই সংঘের উদ্যোগে পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় দীপালী সংঘের সম্মেলনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন লীলা নাগকে শান্তিনিকেতনের কাজে যুক্ত হতে বলেছিলেন। কিন্তু লীলা নাগ পারেননি সেই আমন্ত্রণ রক্ষা রাখতে।
১৯২৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নারী শিক্ষা মন্দির নামের একটি স্কুল। ১৯৩০ সালে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মহিলা সত্যাগ্রহ কমিটির উদ্যোগে ঢাকায় নারীরা গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন। বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অভিযোগে ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর বেঙ্গল অর্ডন্যান্স আইনে তিনি গ্রেপ্তার হন।
লীলা নাগের আরেকটি অসাধারণ উদ্যোগ ছিল জয়শ্রী নামের একটি পত্রিকা প্রকাশনা। ১৯৩১ সালের মে মাসে প্রকাশিত এই পত্রিকাই বাংলাদেশের প্রথম কোনো নারী সম্পাদিত এবং নারীদের দ্বারা পরিচালিত পত্রিকা। পত্রিকাটি সম্পর্কে লীলা নাগ লিখেছিলেন, ‘বাংলার মহিলাদের মুখপত্ররূপে কোন পত্রিকা এ পর্যন্ত ছিল না। এই অভাব দূর করিবার প্রয়াসে জয়শ্রী প্রকাশিত হইলো’।
এই পত্রিকা প্রকাশের জন্য তাকেঁ কারাবরণ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। ১৯৩৫ সালের প্রথমদিকে সরকার পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। কিন্ত ১৯৩৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও তিনি পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্যোগ নেন। একাজে উৎসাহ দিয়ে তাঁকে তখন চিঠি দিয়েছিলেন কবিগুরু।
লীলা নাগের এক ক্লাস উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। লীলা নাগ সম্পর্কে তিনি তার স্মৃতিকথা নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, এঁর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই। এঁর থিওরী হল, নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবলক্লথ প্রভৃতির উপর সুন্দর নক্সা এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সব বিক্রি করে তিনি মেয়েদের একটা উপার্জনের পন্থা উন্মুক্ত করে দেন।”
১৯৪১ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি শরৎচন্দ্র বোসের সাথে মিলে ইউনিটি বোর্ড এবং ন্যাশনাল সার্ভিস ব্রিগেড গঠন করেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনের সময় তিনি এবং তাঁর স্বামী দুজনই গ্রেপ্তার হন এবং তাঁর জয়শ্রী পত্রিকার প্রকাশনা জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪৬ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ভারতীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
দেশভাগ আন্দোলনের সময় সহিংসতা চলাকালে তিনি নোয়াখালীতে গান্ধীজীর সাথে যোগ দেন। গান্ধীজী সেখানে পৌঁছানোর আগেই তিনি সেখানে ত্রাণশিবির খুলেন এবং মাত্র ছয়দিনে ৯০ মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে ৪০০ নারীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর তিনি বিপর্যস্ত ও পরিত্যক্তা নারীদের সহায়তার লক্ষ্যে কলকাতায় চলে যান এবং পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া শরণার্থীদের যথাসাধ্য সাহায্য করেন।
কিছু প্রমাণ মেলে যে, লীলা নাগ ওরফে লীলা রায় জানতেন নেতাজীর অবস্থান সম্পর্কে। ১৯৭০ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত নেতাজীকে সহায়তা করার প্রধান অবলম্বনই ছিলেন লীলা নাগ। তিনি জানতেন নেতাজী বেঁচে আছেন এবং তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তাদের দুজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। অন্যদিকে, লীলা নাগ মারা যাওয়ার আগে নেতাজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিলীপ রায়কে ১৯৬৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে ছিলেন, ‘আমি আপনাকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম আপনার বন্ধু সম্পর্কে-উনি বেঁচে আছেন, ভারতেই’।
আরও একটি চিঠি আছে, যেখানে লীলা রায়কে উৎসর্গ করেছেন নেতাজী। নেতাজী লীলা নাগকে ডাকতেন ‘লী’ বলে। তবে নেতাজীর নামটা উল্লেখ নেই চিঠিতে। বিশেষজ্ঞ বি পালের তথ্যমতে, নেতাজী নিজেকে ঢাকতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর হাতের লেখার সাথে হুবহু মিল নেতাজীর হাতের লেখার।
১৯৬৬ সাল থেকে লীলা নাগের স্বাস্থ্যহানি ঘটতে থাকে। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দুরারোগ্য সেরিব্রালের আক্রমণে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তাঁকে পি.জি. (বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২৩ দিন পর সংজ্ঞা ফিরে এলেও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং ডানদিক সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়।
৪ আগস্ট শেষ সেরিব্রাল আক্রমণে তাঁর সংজ্ঞা লোপ পায়। আড়াই বছর সংজ্ঞাহীন থাকার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন ভারতে এই মহিয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।