লীনা হক: ঈদের ছুটির পরে সকালে অফিসে এসে মেইল খুলেই মনটা খারাপ হলো ! চার দিনে জমা হওয়া প্রায় ১০০ টি মেইল এর জন্য নয় , একটি বিশেষ মেইল আমাদের কম্বোডিয়া অফিস থেকে, বিষয়বস্তু হলো, কম্বোডিয়া ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু দেশের নাগরিকদের জন্য কম্বোডিয়াতে প্রবেশের উপরে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন – আফ্রিকার কিছু দেশ আর বাংলাদেশ সেই সব দেশের তালিকায় আছে ।
বাংলাদেশে কম্বোডিয়ার কোনো কনসুলেট নাই , বাংলাদেশ, নেপাল এবং আরো দু একটি প্রতিবেশী দেশের মানুষজনকে কম্বোডিয়া যেতে হলে দিল্লি অথবা ব্যাংকক থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে হতো – তো গত কিছুদিন থেকে কম্বোডিয়া সরকার ই -ভিসা সিস্টেম চালু করেছে , বাংলাদেশীরা সেখানে অনলাইন অ্যাপ্ল্যাই করে ই-ভিসা পেতে পারে। আমাকে অফিসের সেমিনারে যেতে হবে কম্বোডিয়া, আমাদের সংস্থায় কর্মরত মোট ২৬ জন পৃথিবীর ১৭টি দেশ থেকে এই সপ্তাহের শেষে একত্রিত হবো মেকং নদীর তীরের শহরটিতে। আমার ই-ভিসা নেয়া হয়েছে , মালয়েশিয়ার ট্রানজিট ভিসাও নেয়া হয়েছে ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে আগে কখনো যাইনি, বন্ধু দু একজনের কাছে গল্প শুনেছি, একজন বাংলাদেশী সহকর্মী বর্তমানে কর্মরত আছেন ওখানে , তার কাছ থেকেও একটু জানছি । আর সবজান্তা শমশের ‘গুগল ‘ভাই তো আছেই ! এর মাঝে কন্যার ঘোষণা -কম্বোডিয়ার সিল্ক সুন্দর, অতএব তার জন্য ড্রেসের কাপড় নিয়ে আসতে হবে, কাজেই মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কত কম্বোডিয়ান রিয়েল পাওয়া যাবে সেই হিসেবও যুক্ত হয়েছে করণীয় কাজের তালিকায় । এই অবস্থায় গত শুক্রবারে কম্বোডিয়া অফিসের অ্যাডমিন অফিসার মেইল করেছে – এমনকি ই-ভিসা নেয়ার পরেও আফ্রিকান আর বাংলাদেশী পাসপোর্ট ধারীদের সকল ভ্রমন ডকুমেন্টস নমপেন এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন পুলিসের কাছে অগ্রিম জমা দিতে হবে ।
মেইলটি পড়লাম বার দুই তিন, আমাদের সহকর্মীটি লিখেছে , বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য এই কড়াকড়িটি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে, কারণ গত কিছুদিন আগে বেশ কিছু বাংলাদেশী পাসপোর্ট ধারী নাগরিক কম্বোডিয়া থেকে নৌকা করে দক্ষিণ চায়না সাগর পাড়ি দিয়ে চীনে অবৈধ অভিবাসন করার চেষ্টা করে ধরা পরেছে , দু একজনকে ডিপোর্ট করা হয়েছে, বাকীরা গরাদের ওইপারে । তবে আমার দুঃশ্চিন্তার কিছু নাই অফিস যথাসময়ে আমার কম্বোডিয়া ভ্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় পেপারওয়ার্ক শেষ করে ফেলবে। নেপাল বা ইন্ডিয়া এই তালিকায় নেই। আমার নেপালী সহকর্মী বন্ধু আমাকে আলাদাভাবে লিখেছে , সে এই মেইলটি পড়ে মর্মাহত এবং সে বুঝতে পারছে আমার কত খারাপ লাগছে এই ব্যাপারটিতে ।
খারাপ আমার লাগছে – এটা সত্য , এটাও সত্য যে শুধু কম্বোডিয়াতে নয় পৃথিবীর আরো অনেক দেশেই বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টধারীদের জন্য আলাদা ভিসার নিয়ম বা এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে আলাদা লাইন । কিন্তু মনের মধ্যে যে কথাটি খোঁচা দিচ্ছে , এত কষ্ট করে , এত টাকা খরচ করে (এই সব অভিবাসন প্রক্রিয়ায় লক্ষ লক্ষ টাকা দালালরা নিয়ে থাকে) যেই বাংলাদেশী তরুণরা এই রকম অসম্ভব অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ায় , তাদের আর যাই হোক সাহস বা দুঃসাহসের কমতি নাই। যেই পরিমাণ টাকার বিনিময়ে তারা ভিনদেশের কারাবাস বা অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু সম্ভাবনাকেও পরোয়া করে না , তারা কেন দেশে কিছু করার চেষ্টা করে না ! কেন আমাদের তরুণরা দেশে কিছু করার আগ্রহ বোধ করে না ! জানি , এই বিষয়ে অনেক তর্ক থাকতে পারে , থাকতে পারে ভিন্নমত, কিন্তু মূল কথাটা তো সেই , যে কোনো যৌক্তিক অথবা অযৌক্তিক কারণেই হোক না কেন, আমাদের ছেলেরা এমনকি মৃত্যু সম্ভাবনা জেনেও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা রাখছে । কেন তারা এটা করছে ! আমাদের নেতারা, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এবং আমাদের রাষ্ট্র যন্ত্র – কার কাছে জানতে চাইবো !
লেখক: উন্নয়ন কর্মী।