উইমেন চ্যাপ্টার: বিপ্লব যার রক্তে বহমান, প্রবল পরাক্রমশালী শত্রুর সামনেও যিনি মাথা নোয়াননি কখনও, নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনও যাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি আদর্শ থেকে, সেই নাচোলের রানী খ্যাত ইলা মিত্রের আজ জন্মদিন। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতাতে জন্ম নিয়েছিলেন এই নেত্রী। গত ১৩ অক্টোবর ছিল তাঁর ১১ তম মহাপ্রয়ান দিবস। ২০০২ সালের এইদিনে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
দুই বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তী নেত্রী ইলা মিত্র তৃণমূল পর্যায়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আর এর মাশুলও তাঁকে দিতে হয়েছিল অত্যন্ত নৃশংসভাবে। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সালে রাজশাহী, মালদাহ, চন্ডী রামপুর অঞ্চলের কৃষকদের নিয়ে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ইতিহাসের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
তিনি তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘বিগত ০৭.০১.৫০ তারিখে আমি রোহনপুর থেকে গ্রেপ্তার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোল থানা হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। কিন্তু পথে পাহারাদার পুলিশরা আমার ওপর অত্যাচার করে। নাচোলে ওরা আমাকে একটা সেলের মধ্যে রাখে। সেখানে একজন পুলিশের দারোগা আমাকে এ মর্মে ভীতি প্রদর্শন করে যে, আমি যদি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি না করি, তাহলে ওরা আমাকে উলঙ্গ করবে। আমার যেহেতু বলার মত কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার পরনের সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় সেলের মধ্যে আটকে রাখে। আমাকে কোন খাবার দেওয়া হয়নি। এমন কি এক বিন্দু জলও না। ঐ সন্ধ্যায় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য এসআইএর উপস্থিতিতে সিপাইরা এসে বন্দুকের বাট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর ওরা আমার পরনের কাপড় চোপড় ফেরত দেয়। রাত প্রায় বারোটার সময় আমাকে বের করে সম্ভবত এসআইএর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি খুব বেশি নিশ্চিত ছিলাম না।
আমাকে যে কামরায় নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে আমার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ওরা নৃশংস ধরনের পন্থা অবলম্বন করে। আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে ওরা আমার পা দুটোকে লাঠির মধ্যে রেখে ক্রমাগতভাবে চাপ দিতে শুরু করে। ওদের ভাষায় আমার বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানী ইনজেকশন’ পন্থায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল। এ ধরনের অত্যাচার চলার সময় ওরা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে রেখেছিল এবং আমার চুল ধরেও টান দিচ্ছিল। কিন্তু আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক কিছুই বলাতে সক্ষম হয়নি। এতসব অত্যাচারের দরুণ আমার পক্ষে আর হেঁটে যওয়া সম্ভব ছিল না। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে নিয়ে গেল। এবার পুলিশের সেই দারোগা সিপাহীদের ৪টা গরম ডিম আনার নির্দেশ দিয়ে বলল যে, এবার মেয়েটাকে কথা বলতেই হবে। তারপর শুরু হল নতুন ধরনের অত্যাচার। ৪/৫ জন সিপাহী মিলে জোর করে আমাকে চিত্ হয়ে শুতে বাধ্য করল এবং ওদের একজন আমার গোপন অঙ্গ দিয়ে একটা ডিম ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। সে এক ভয়াবহ জ্বালা। প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করলাম, আমার ভিতরটা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
১৯৫০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে আমার জ্ঞান ফিরে এলো। একটু পরে জনাকয়েক পুলিশ সঙ্গে করে আবার সেই দারোগার আগমন ঘটে। সেলে ঢুকেই সে আমার তলপেটে বুট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে লাথি মারে। আমি দারুণ ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম। এরপর ওরা জোর করে আমার ডান পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটা লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দিল। আমি তখন অর্ধ-চৈতন্য অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছি। কোন রকম স্বীকারোক্তি না পেয়ে দারোগা তখন রাগে অগ্নিশর্মা। যাওয়ার আগে বলে গেল, আমরা আবার রাতে আসব। তখন তুমি স্বীকারোক্তি না দিলে, একের পর এক সিপাহী তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাতে দারোগা আর সিপাহীরা আবার এলো এবং আবারো হুমকি দিল স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি তখনও কিছু বলতে অস্বীকার করলাম। এবার দু জন মিলে আমাকে মেঝেতে ফেলে ধরে রাখল এবং একজন সেপাহী আমাকে রীতিমত ধর্ষণ করতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম…।” (সূত্র: ড. নিবেদিতা দাশপুরকায়স্থ, মুক্তিমঞ্চে নারী, প্রিপ ট্রাস্ট, ১৯৯৯, ঢাকা)
তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন বাগুটিয়ার, যার বর্তমান নাম বাংলাদেশের ঝিনাইদহ। তাঁর বাবা নগেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন বাংলার একাউন্টেট জেনারেল। কলকাতার বেথুন কলেজে পড়ার সময় থেকে ইলা মিত্র জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সাথে। ১৯৪২ সালে তিনি আইএ পাশ করেন এবং ১৯৪৪ সালে বিএ অনার্স। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট শিক্ষার্থী হিসেবে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এমএ করেন আরও অনেক পরের দিকে ১৯৫৭ সালে। তিনি কলকাতা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি এবং সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।
১৯৪৫ সালে ইলা মিত্রের বিয়ে হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের জমিদার পরিবারের ছেলে রমেন্দ্র মিত্রের সাথে এবং তিনিও কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। স্বামী সাথে শ্বশুরবাড়িতে এসে ইলা মিত্র নিজেদেরই প্রতিষ্ঠিত একটি বালিকা বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক নিযুক্ত হন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ভূমি রাজস্ব কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং নেতৃত্ব দেন। এছাড়া তিনি নাচোল বিদ্রোহ এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সময়টা ছিল ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত।
১৯৪৬ সালে ইলা মিত্র এবং অন্যান্য স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা প্রতিহত করতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেসময় মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী সফরে এলে ইলা মিত্র দাঙ্গা-বিধ্বস্ত গ্রাম হাসনাবাদে যান।
১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি নাচোলে কৃষক এবং পুলিশের সংঘর্ষের জের ধরে সেখানে প্রায় দুই হাজার সশস্ত্র পুলিশ পাঠানো হয়। কিন্তু শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে তাদের পাঠানো হলেও তারা বেশ কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয় এবং বহু গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তারা ইলা মিত্রকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তাঁকে ২১ জানুয়ারি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। ইলা মিত্রকে তখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে তৎকালীন সরকার।
কিন্তু কারাগারে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন ইলা মিত্র এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে কলকাতায় পাঠায় চিকিত্সার জন্য। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আর দেশে ফেরেননি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন আন্দোলন-তত্পরতায় সক্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চার বার তিনি বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভারতে জনমত গড়ে তুলতে তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ইলা মিত্র।
রাজনীতির পাশাপাশি ইলা মিত্র সাহিত্যের অনুরাগীও ছিলেন। তাঁর অনুবাদের কাজের জন্য ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু’ সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে ‘তাম্রপত্র’ পুরস্কার দেয়। (তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া)।
তেভাগা ও শোষণমুক্তির আন্দোলনের লড়াকু বিপ্লবী ইলা মিত্র’র আজ জন্মদিন। যিনি বাঙালিদের মুক্তির জন্য সহ্য করেছেন অসহনীয় নির্যাতন। মহান এই বাঙালি বিপ্লবীকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
জয়তু ইলা মিত্র।।উইমেন চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে বিপ্লবী এই মহান নেত্রীকে স্যালুট।