উইমেন চ্যাপ্টার: রংপুরের বদরগঞ্জের ঘটনা, গ্রামের কয়েকশ লোকের সামনে বেধড়ক পেটাচ্ছে দুজনকে। সবাই নীরব দর্শক হলেও নীরব নেই ওই দুজনের একজনের মেয়েরা। একেবারেই শিশু এখনও বয়সে। তাদের চোখের সামনে প্রিয় বাবাকে এমন মারধর দেখে ওরা আর সহ্য করতে পারেনি। বার বার এসে লুটিয়ে পড়ছে বাবার ওপর। বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেই যাচ্ছে ওরা। কিন্তু ওদের কথা শুনবে কে? ওদেন কান্না কাউকে স্পর্শ করতে পারেনি দীর্ঘক্ষণ। অবশেষে বোধোদয় ঘটে, বাবা এবং অপর লোকটিকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ নিয়ে যায় হাজতে।
আমজাদ না থাকায় ঈদের দিন নিরন্ন-অভুক্ত কেটেছে পরিবারগুলোর। বড় মেয়ে দুটির মুখে দানাপানিও দেওয়া যায়নি। কেবল একটিই কথা, বাবা আসুক। ছবিটি দেখুন, সন্তানের সামনে যেভাবে এক গরু চুরি দায়ে পিটানো হচ্ছে, তা কি কোন মানবিক সমাজের ইঙ্গিত দেয়?
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার রংপুরের বদরগঞ্জের অটোরিকশাচালক আমজাদ হোসেনের পরিবারের লোকজন ঈদের দিনটি না খেয়েই কাটিয়েছেন। আমজাদের তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে আফরিন আখতার (১০) ও আঁখি আখতার (৭) বাবার জন্য দিনভর কান্নাকাটি করেছে। তাদের মন থেকে বাবাকে মারার ঘটনার পর ভয় ও আতঙ্ক কাটছে না।
কিন্তু বাবা আসবে কি করে? তৃণমূলের নেতারা তো তার বিপক্ষে, প্রশাসন কিংবা কোনো মানবাধিকার সংস্থা কেউই এখনও এগিয়ে আসেনি। আমজাদের বৃদ্ধা মা আমেনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন,‘বাবা, আমার ছেলে আসবে কখন। ভোটে চেয়ারম্যানের বিপক্ষে কাজ করায় তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে জেলে দিয়েছে। ছেলের হাত-পা বেঁধে চেয়ারম্যান আমার সামনে পিটাইছে।
প্রতিবেশীরা সবাই একবাক্যে জানান, আমজাদ খুব ভালো মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ মিথ্যা। সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসানো হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। সবারই এককথা, নির্বাচনের সময় পক্ষ না নেওয়ায় এভাবে তাকে চুরির দায়ে ফাঁসানো হলো।
আমজাদ হোসেনের বড় মেয়ে আফরিন আখতার কেঁদে কেঁদে বলে, ‘আমার বাবাকে ওরা খুব মারছে। বাবা না আসা পর্যন্ত আমি খাব না। আমার বাবা খুব ভালো।’
দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমজাদ হোসেনের বাবা আবদুল গফুরের নাম অনুযায়ী গ্রামের নামকরণ হয়েছে ‘গফুরের পাড়া গ্রাম’। বাবা আবদুল গফুর এখনো বেঁচে আছেন। আমজাদসহ তাঁর দুই ছেলে, চার মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর এখনো চার একর ৫০ শতক আবাদি জমি রয়েছে। এর মধ্যে তিন একর জমি দুই ছেলেকে ভাগ করে দিয়েছেন। এক একর ৫০ শতক বসতভিটায় তিনটি টিনশেডের পাকা কক্ষ ও তিনটি গোয়ালঘর রয়েছে।
আবদুল গফুর বলেন, ‘আমার ছেলে চোর—এটা কালুপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিক ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। আমজাদ খুব পরিশ্রমী ও লাজুক ছেলে। জমির কাজ না থাকলে সে চট্টগ্রামে গিয়ে অটোরিকশা চালায়। ভোটের সময় চেয়ারম্যানের বিপক্ষে কাজ করায় ছেলেটাকে চোরাই গরু রাখার অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘চেয়ারম্যান এলাকায় চোর-ডাকাত নিজে পোষেণ। নির্যাতনের ভয়ে চেয়ারম্যানের বিপক্ষে এলাকায় কেউ কথা বলেন না। এখন চেয়ারম্যান আমাদের আরও মামলা মোকদ্দমার ভয় দেখাচ্ছেন।’ তিনি চেয়ারম্যানের বিচার দাবি করেন।
আমজাদ হোসেন কোরবানির জন্য স্থানীয় কাঁচাবাড়ি মৌলভীপাড়া গ্রামের ছহিরুল ইসলামের কাছ থেকে গত শনিবার ১১ হাজার টাকায় একটি গরু কেনেন। পরদিন চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিকের নির্দেশে গ্রাম পুলিশের সদস্যরা গরু কেনার বৈধ কাগজপত্র (হাসিল) না পেয়ে আমজাদ হোসেন ও গরুর বিক্রেতা ছহিরুলকে আটক করেন। এরপর ওই দুজনকে চেয়ারম্যান ও গ্রাম পুলিশের সদস্যরা কোমরে দড়ি বেঁধে পেটাতে পেটাতে এলাকায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান। পরে তাঁদের বৈরামপুর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়।
চেয়ারম্যান উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার পক্ষে যারা ভোট করেছে তারা মদাড়ু, জুয়াড়ু বা চোর নয়। আমার বিরুদ্ধে যারা ভোট খেলছে তারা ভালো মানুষ না। যাদের ধরা হয়েছে তাদের কী করা উচিত?’ এ সময় চেয়ারম্যানের লোকজন বলে ওঠেন, ‘ফাঁসি দেওয়া উচিত।’ এরপর শুরু হয় বেধড়ক পেটানো। এ সময় আমজাদের দুই অবুঝ মেয়ে বাবাকে না পেটানোর জন্য চেয়ারম্যান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে পায়ে ধরেন। কিন্তু তাঁদের মন গলেনি। অবুঝ শিশুদের সামনেই হাত-পা বেঁধে মাটিতে ফেলে আমজাদকে পেটানো হয়। চার ঘণ্টা পেটানোর পর তাঁদের থানা পুলিশে দেওয়া হয়।
এর আগেও বদরগঞ্জে দুই নারীকে এভাবে সবার সামনে ব্রেধড়ক পেটায় গ্রামের লোকজন। সেই ঘটনারও কোন বিচার আজতক হয়নি।