উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক: ‘তানজানিয়ার মেয়েদের ‘খৎনা’ করানো হয় বিয়ে দেওয়ার জন্য, যাতে যখন সে সন্তানধারণ করবে তখন যেন পরিবারের লজ্জার কারণ না হয়’- কথাটি বলছিলেন ২৬ বছর বয়সী গর্বিত স্কুল শিক্ষক নেনগাই লাজারো। তানজানিয়ার যে গ্রামটিতে তিনি বড় হয়েছেন, আশপাশের সব মেয়েরই ‘খৎনা’ করা। সাধারণত প্রাথমিক শিক্ষাশেষে এই কাজটি করা হয়।
নেনগাই লাজারো দেশটির আরুশার কাছে একটি স্কুলে কিশোরী মেয়েদের পড়ান। তার মা খুবই গরীব পরিবারের মেয়ে ছিলেন। মাত্র নয় বছর বয়সে পঞ্চম স্ত্রী হিসেবে একজনের সাথে বিয়ে হয় তার। ওই অঞ্চলে মেয়েদের সংখ্যা ছিল অগুনতি। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে অন্য সবার মতো নেনগাইও কঠিন বাস্তবের মুখে পড়েন। কোন ধনী ব্যক্তির সাথে যাতে তার বিয়ে হয়, সেই আশাতেই তার বাবা তার ‘খৎনা’ করাতে আগ্রহী হন। এবারও স্বামী নির্বাচন করা হয় এমন একজনকে যার এ্ররই মধ্যে চার-চারজন স্ত্রী ছিল। এই বিয়ের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ হয় কিছু গরু।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মতে, ১৪০ মিলিয়ন নারী ও কন্যাশিশু খৎনার শিকার হন। বিশ্বব্যাপী এই প্রক্রিয়া নারী যৌনাঙ্গচ্ছেদন নামে পরিচিত। এর সবটাই প্রায় ঘটে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। আর এটা সম্পৃক্ত মেয়েদের বাল্যবিবাহ এবং পড়াশোনার সমাপ্তির সাথে। যখন একজন শিশুকে খৎনার শিকার হতে হয়, সাধারণত তার বয়স থাকে নয় বছর। বিয়ে বিষয়টাই তার এসময় মাথায় ঢোকার কথা না। কিন্তু স্থানীয়ভাবে এটিকে ‘প্রথা’ হিসেবে ধরে নিয়েই এর আইনগত ভিত্তি দেওয়া হয়। তবে বিশ্বব্যাপী এটি সুপরিচিত মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবেই।
খৎনার এই পুরো প্রক্রিয়াটির সাথে শারীরিক ও মানসিক আঘাত সম্পৃক্ত। তাছাড়া এটি এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের আশংকাও বাড়িয়ে দেয়। কারণ এতে যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়, আর প্রচুর রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে সংক্রমণ ছাড়াও মৃত্যুর আশংকাও থাকে।
নেনগাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মনে করে বলেন, কতটা ভয় তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু এটাও বলেন যে, তার কোন ধারণাই ছিল না পুরো প্রক্রিয়াটি কতটা ভয়াবহ এবং যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। ট্রমা এবং আতংকিত হয়ে তিনি তার মাকে বলেছিলেন, তার কষ্টের কথা এবং বিয়ে সম্পর্কে ভীতির কথা। মা শুধু একটা কথাই তাকে বলেছিলেন, ‘পালিয়ে যাও’।
নেনগাই তখন পালিয়ে যান এবং একজন শিক্ষকের কাছে আশ্রয় চান। সেই শিক্ষক নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন নেনগাইকে আশ্রয় দেন এবং মাসাই গার্লস লুথেরান চার্চ সেকেন্ডারি স্কুলে নিয়ে যান। সেখানে পড়াশোনা এবং শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ শেষ করার পর থেকে নেনগাই পাশেই আরুশা এবং মানিয়ারাতে কাজ করছেন। আর এই অঞ্চলেই দীর্ঘ বছর ধরে নারী ও কন্যা শিশুর শিক্ষার লক্ষ্যে কাজ করছে জাতিসংঘের উইমেন্স পার্টনার অর্গানাইজেশন মাসাই উইমেন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এমডব্লিউইডিও)।
এমডব্লিউইডিও গার্লস স্কুলে ৮৬ জন মেয়েকে চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে অথবা বিয়ে দেওয়া হয়েছে ছোট বয়সেই। এদের সনাক্ত করার পর ন্যূনতম শিক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়েছে, যাতে করে তারা তাদের পরিবারে যৌতুকের চেয়েও মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে।
নেনগাইয়ের ক্লাসের ১৫ বছরের কিশোরী নারাউ বলেন, ‘নেনগাইয়ের গল্প আমাকে খুবই কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু আমি ভাগ্যবান যে, তিনি আমার শিক্ষক। কারণ তার পক্ষেই সম্ভব আমাদের সম্পূর্ণ বুঝে উঠা। তিনি জানেন, বিষয়টা কতটা মর্মান্তিক। আমি বিয়ে করিনি, কিন্তু এই স্কুলটা না থাকলে বিয়ে করতে বাধ্য হতাম এবং এতোদিনে হয়তো আমার বাচ্চা-কাচ্চাও হয়ে যেত’।
নারাউয়ের সহপাঠী ১৪ বছর বয়সী মেরেসো বলছিল, তিন বছর আগে এমডব্লিউইডিও থেকে স্কলারশিপ পাওয়ার পর তার মা ও ভাই খুবই আনন্দিত হয়েছিল। এই বৃত্তিটা না পেলে এতোদিনে তার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হতো। কিন্তু তার বাবা এই ঘটনায় দু:খ পেয়েছিল। মেরেসো জানায়, তার বাবার পরিকল্পনা ছিল তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দেওয়ার। কিন্তু পড়াশোনা তার জগতটাকে বাড়িয়ে দেয়। স্কুলে তার প্রিয় বিষয় হচ্ছে ইতিহাস, উপনিবেশিক অর্থনীতি, প্রতিবন্ধকতা এবং সহযোগিতা। সে জানায়, নিজের দেশের ইতিহাস তাকে অনেক বেশি উৎসাহিত করেছে পড়াশোনায়। তিনি একজন আইনজীবী হতে চান এবং বাল্যবিয়ে থেকে কন্যাশিশুদের বাঁচাতে কাজ করতে চান।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে ১৬ দিনব্যাপী অ্যাক্টিভিজম ক্যাম্পেইন এর অংশ হিসেবে জাতিসংঘ উইমেন এবং জাতিসংঘ তানিজানিয়া ইন্টার-এজেন্সি জেন্ডার গ্রুপ একটি প্রকল্পে সহায়তা করছে, যার নাম হচ্ছে ‘কারাভান ফর চেঞ্জ’। একটি বাসে এমন ২৫ জন অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিক এবং এনজিও কর্মীকে রাখা হয়েছে, যারা ফোরাম গড়ে তুলেছেন, রেডিও ইভেন্ট বানিয়েছেন, নাচ-গানের ব্যবস্থা করেছেন এবং দেশের এই নৃশংস খৎনা প্রক্রিয়া বেআইনী ঘোষণায় বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, তারা এই প্রথাটি রোধে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি বাল্যবিয়ের মতো অমানবিক কাজও রোধ করতে পারবেন। এবং সেদিন খুব কাছেই।