সুচের ফোঁড়ে জীবনের জয়গান

Hosne Ara
হোসনেয়ারা

রাজীব নূর: ১৯৮৮ সালের একদিন হোসনেয়ারা বেগমের স্বামী কাহহার উদ্দিন সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলেন। দিন-তারিখ মনে নেই হোসনেয়ারার। মনে আছে, তখন বর্ষাকাল। পথঘাট পানিতে থই থই করছে। দেশজুড়ে যখন দুর্যোগ চলছে, তখন এ দুর্ঘটনা হোসনেয়ারার জীবনে দুর্যোগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল।
দুর্ঘটনার সময় হোসনেয়ারা ও কাহহার দম্পতির তিন মেয়ের বড়টির বয়স তিন বছর, ছোটটির মাত্র তিন মাস। আকাশ ভেঙে পড়ে হোসনেয়ারার মাথায়।

বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাতে তুলে নিলেন সুঁই-সুতা। পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজে তো রক্ষা পেলেনই, স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় বের করে আনলেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার গোয়ালদী গ্রামের আরও অনেক নারীর।

হোসনেয়ারা জানান, খুব ছোটবেলা থেকে সেলাইয়ের কাজে তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল। শুরুটা হয়েছিল পরিত্যক্ত কাপড়ে নিজের জন্য খেলনা পুতুল বানানো দিয়ে। তবে পড়াশোনায় মন্দ ছিলেন না। কিন্তু পুতুল খেলার দিন ফুরানোর আগেই বিয়ের বাদ্য বেজে গেল বলে সপ্তম শ্রেণীর বেশি পড়া হলো না তাঁর। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে এবং ২০ বছরের মধ্যে হয়ে গেলেন তিন মেয়ের জননী।

ভালোই চলছিল তাঁদের। হোসনেয়ারা ও কাহহারের সংসারে কখনোই তেমন সচ্ছলতা ছিল না। তবে দুর্ঘটনায় কাহহার পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের অনাহারে কাটাতে হয়নি কোনো দিন।

অনাহারের দিন: অনাহার ও অর্ধাহারে কাটানো ওই দিনগুলোর কথা হোসনেয়ারা কোনো দিনই ভুলতে পারবেন না। বাপের বাড়ির ওপরও নির্ভর করার অবস্থা ছিল না।

কাহহার পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর পুরো বর্ষাকাল ভয়াবহ দুর্বিপাকের মধ্যে কেটেছে হোসনেয়ারার। বর্ষা শেষে হঠাৎ করেই বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ নামের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান আয়োজিত সূচিকর্মবিষয়ক কর্মশালায় যোগ দিয়ে অভাব থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেয়ে গেলেন। ওই কর্মশালায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সূচিকর্মের অভিজ্ঞতাটা আরও ঝালাই করার সুযোগ পেলেন তিনি। সেই সঙ্গে পেলেন সূচিকর্ম দিয়ে রোজগারের সুযোগও।

এ কর্মশালার মাধ্যমে যোগাযোগ হলো ঢাকার বারিধারায় অবস্থিত হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান ‘ডিজাইনার লাইনে’র সঙ্গে। সেখান থেকে শাড়ি-পাঞ্জাবি এনে সুতা দিয়ে নকশা করা শুরু করেন। শুরুতে ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়ালমেটও তৈরি করতেন। হোসনেয়ারার মনে আছে, একেকটি বড় ওয়ালমেট তৈরির জন্য ৫০ টাকা এবং ছোটগুলো প্রতিটির জন্য ৩০ টাকা করে মজুরি পেতেন। হোসনেয়ারা তখন থেকেই ঢাকা থেকে কাজ এনে গ্রামের মেয়েদের মাধ্যমে কাজ করাতে শুরু করেন এবং প্রতিটি কাজ থেকে নিজের জন্য পাঁচ থেকে সাত টাকা রেখে দিতেন। তাই নিজের কাজের পরিমাণ বাড়ানোর জন্যই গোয়ালদী গ্রামের কুলসুম বেগম, ইভা আখতার, খুকুমণি, আঁখি সুলতানা, লুৎফা আখতারসহ ১০-১২ জনকে হাতে-কলমে কাজটি শিখিয়ে নেন। এখন অবশ্য গোয়ালদী ও আশপাশের গ্রাম মিলিয়ে শ খানেক নারী নকশিকাঁথার কাজ করছেন।

গ্রামের মেয়েদের কাজ শেখানোর সময় নিজে আরও দক্ষতা অর্জনের জন্য নকশিকাঁথার মাঠ নামের ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজেই একটি কাঁথা সেলাই শুরু করেন। পুরো তিন মাস লেগেছিল প্রথম কাঁথাটি তৈরি করতে। কাঁথাটি ওই সময়েই সাত হাজার টাকা বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু হোসনেয়ারা ও তাঁর সহকর্মীরা পেয়েছিলেন মাত্র এক হাজার টাকা। তবে এ ঘটনার পর হোসনেয়ারা উপলব্ধি করেন, চাইলে তাঁরা নিজেরাই নকশিকাঁথা তৈরির কাজটা শুরু করতে পারেন। কারণ, কাঁথা তৈরির জন্য মূলধন খুব একটা লাগে না, লাগে পরিশ্রম।

শিল্প না সংগ্রাম: সোনারগাঁয়ের ইতিহাস ও লোকশিল্প গবেষক শামসুদ্দৌহা চৌধুরীর মতে, মসলিন ও জামদানির জন্য বিখ্যাত সোনারগাঁয়ে নকশিকাঁথার প্রাচীন কোনো ঐতিহ্য নেই। হাল আমলে সোনারগাঁয়ে যে নকশিকাঁথা তৈরি হচ্ছে, তা হোসনেয়ারার হাত ধরেই শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, হোসনেয়ারা সুঁই-সুতায় চমৎকার সব প্রতিকৃতিও করতে পারেন। তিনি একজন উঁচু মানের সূচিশিল্পী।

হোসনেয়ারা জানান, একসময় তিনি সূচিকর্মের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানী, মাদার তেরেসা, মহাত্মা গান্ধী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ শ’খানেক বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। এখন কাঁথার কাজের চাপে প্রতিকৃতি আর করেন না। প্রতিকৃতি করে খুব একটা আয় হয় না।

হোসনেয়ারার কাছে শিল্প আসলে কী তা বোঝা গেল। তিনি নিজেও বলেন, ‘ইদানীং মানুষজন আমার হাতের কাজের প্রশংসা করে। শুনতে ভালোই লাগে। তবে আমি ভাই প্রশংসা পাওয়ার জন্য নয়, বাচ্চার দুধের খরচ, স্বামীর চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের লাইগ্যা কাজ শুরু করছিলাম। এই কাজ করেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। মেয়েদের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছি।’

হোসনেয়ারার তিন মেয়ে ইয়াসমিন, আসমা ও নার্গিস অবশ্য মায়ের সংগ্রামে সর্বদাই সঙ্গ দিয়েছেন। মায়ের কাছ থেকে সেলাইয়ের কাজ শিখেছেন তাঁরা। মেজো মেয়ে আসমা ও ছোট মেয়ে নার্গিস সেলাইয়ের পাশাপাশি মাটির গয়না তৈরির কাজও করেন।

স্বীকৃতি ও পুরস্কার: নকশিকাঁথায় হোসনেয়ারার আঁকা গ্রামের মেঠোপথ, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, সবুজ গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে চলা পাখি, কলসি কাঁখে নদী থেকে পানি আনতে যাওয়া বধূটি, লাঙল কাঁধে কৃষকের হালচাষ করতে যাওয়ার দৃশ্য মানুষকে মুগ্ধ করে।

মুগ্ধতার স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। ২০১১ সালে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন থেকে নকশিকাঁথা বুনন ও বিপণনে সফল ব্যবসায়ীর স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন এক ভরি ওজনের একটি স্বর্ণপদক ও নগদ ৩০ হাজার টাকা।

লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক রবীন্দ্র গোপ জানান, পুরস্কার পাওয়ার পর হোসনেয়ারাকে ফাউন্ডেশনের একজন প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে তাঁর নামে একটি দোকানও বরাদ্দ করা হয়েছে।

একজন প্রশিক্ষক: দোকান পেয়ে এখন একটু থিতু হয়েছেন হোসনেয়ারা—তিনি নিজেই বললেন এ কথা। খুব একটা সচ্ছলতা না এলেও কঠিন সংগ্রামের দিন শেষ হয়েছে তাঁর। তাই অন্যদের শেখানোর কাজটা আরও ভালোভাবে করতে চান তিনি।

হোসনেয়ারা বলেন, ১৯৮৮ সালে কাজ শুরু করার পর থেকে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। প্রথম থেকেই ঢাকায় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মেলা এবং সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প মেলায় অংশগ্রহণ করে আসছেন। এসব মেলা থেকে বড় বড় প্রতিষ্ঠান, যেমন আড়ং ও টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। মেলাগুলো থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের নকশা সম্পর্কে তাঁর ধারণা হয়। যশোর ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের নকশিকাঁথা জমকালো নকশানির্ভর। তাঁর নিজের পছন্দ জামালপুর অঞ্চলের নকশিকাঁথার কাজ। ওই অঞ্চলের মেয়েরা নকশিকাঁথা সেলাইয়ের মাধ্যমে গল্প আঁকে। তিনিও গল্প আঁকাটাই শেখাতে চান।

হোসনেয়ারা লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি সোনারগাঁয়ের আরও একটি সামাজিক সংগঠন সুবর্ণগ্রামের উদ্যোগে সেখানকার জেলেপাড়া, ঋষিপাড়া ও বেদে বহরের নারীদের নকশিকাঁথা তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। হোসনেয়ারার কাছে প্রশিক্ষিত ২০ জন জেলে, ঋষি ও বেদে নারীর জীবন ও সংগ্রামের গল্প নিয়ে তৈরি কাঁথা এবার জাতিসংঘের কাঁথা প্রদর্শনীতে প্রদর্শনের জন্য পাঠানো হয়েছে।

(লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন: